banner
left-barhomeaboutpast-issuesarchiveright-bar

অপমানিত দলিতের উত্থান

কাজল মুখার্জি
(মন্থন সাময়িকী)

dalit-manthan

দক্ষিণ গুজরাতের গির সোমনাথ জেলার উনা তালুকের সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মোটা সমাধিওয়ালা গ্রাম। গির সোমনাথ পূর্বতন জুনাগড় জেলার অংশ। গ্রামে প্রায় ২৪০০ মানুষের বাস, যাদের অধিকাংশ আহির, প্যাটেল, দলিত এবং নাপিত। দলিতদের মধ্যে চামার জাতের ২৭টি পরিবার এখানে রয়েছে। এরা মূলত ভূমিহীন চাষি, মাত্র কয়েকজন দলিতের সামান্য চাষের জমি রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটা পরিবার পশু-চামড়া ছাড়ানো এবং তা শুকিয়ে পাকা করা বা ট্যানিং-এর কাজে লিপ্ত। এই কাজে তারা নিজেদের গ্রাম ছাড়িয়ে আশপাশের গ্রামেও যায়। প্রত্যেক শুক্রবারে পর্যায়ক্রমে এক-একটা পরিবারের কাজের সুযোগ আসে। যেহেতু গ্রামের পঞ্চায়েত এই কাজের জন্য কোনো স্থান বরাদ্দ করেনি, তাই দলিতেরাই নিজেদের মতো কাজের জায়গা আর মৃত পশু ফেলার জায়গা স্থির করে নিয়েছে।

          ১১ জুলাই ২০১৬। এই গ্রামের বালুভাই সারভাইয়ার কাছে বেদিয়া গ্রামের নাজভাই দানাভাই আহিরের কাছ থেকে একটা ফোন আসে। তাঁর গরুটাকে একটা সিংহ এসে আক্রমণ করে মেরে ফেলেছে। সেই মরা গরুকে সরানো দরকার। বালুভাই সেখানে গিয়ে মরা গরুটাকে সমাধিওয়ালা গ্রামে নিয়ে এলেন। এরপর মোতিসারা গ্রামের জিভাভাই কোলি-র কাছ থেকে ফোন পেয়ে তিনি ছেলেকে ডাকলেন। মোতিসারা থেকেও একটা মরা গরু নিয়ে আসতে হবে। সব গরুগুলোকে নিয়ে আসা হল মোটা সমাধিওয়ালা আর বেদিয়া গ্রামের সীমান্তে আবর্জনা ফেলার জায়গায়। সকাল দশটা নাগাদ ভাশারাম সারভাইয়া, রমেশ সারভাইয়া, বেচার সারভাইয়া আর অশোক সারভাইয়া নামে চার যুবক ওই গরুগুলোর চামড়া ছাড়াতে শুরু করল। এরা প্রত্যেকেই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে খামারে কাজ করত, আবার প্রথাগতভাবে ট্যানারিতেও কাজ করত।

          তারা যখন গরুর লাশ থেকে চামড়া ছাড়াচ্ছিল, তখনই এক ক্ষিপ্ত জনতা ওদের আক্রমণ করে। ওরা একটা সাদা গাড়ি করে ঘটনাস্থলে এসেছিল। ওরা এসেই জিজ্ঞেস করে, কেন তোরা গো-হত্যা করছিস? দলিত যুবকেরা জবাব দেয়, ‘গরু তো মৃত। আমরা শুধুমাত্র চামড়া ছাড়িয়ে নিচ্ছি।’ কিন্তু ওরা গালিগালাজ করতে থাকে --- ‘শালো, জিন্দা গায়োকো কাট রহে হো!’ জাত তুলে নোংরা খিস্তি দিয়ে ওরা লোহার পাইপ নিয়ে ওই যুবকদের আক্রমণ করে। যে ছুরি দিয়ে যুবকেরা চামড়া ছাড়াচ্ছিল, সেগুলো কেড়ে নিয়ে সেগুলো দিয়েও যুবকদের আঘাত করে।

          সেই ঘটনা দেখে দেবীপূজক জাতের এক ব্যক্তি বালুভাইকে ফোনে খবর দেন যে তাঁর ছেলে আর চার যুবককে একদল লোক মারধোর করছে। বালুভাই তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে হামলাকারী জনতার কাছে ছেলেদের জীবন ভিক্ষা করেন। তিনি ওদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তাঁরা জাতে চামার আর মৃত প্রাণীদের নিয়েই তাঁদের কাজ-কারবার। একথা শুনে ওরা বালুভাই এবং তাঁর পরিবারের লোকদের মারতে শুরু করে। এরপর ওরা এদের মধ্যে চারজনকে একটা গাড়িতে তুলে নেয় এবং উনা শহরে নিয়ে আসে। সেখানে জামাকাপড় জোর করে খুলে ফেলে নগ্ন করে চারজনকে বেঁধে প্রকাশ্য রাস্তার মধ্যে হাঁটানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে লাঠি আর ডাণ্ডা দিয়ে মার। আক্রান্ত যুবকদের রক্ষা করার জন্য কাউকে এগোতে দেওয়া হয়নি। হামলা চলাকালীন ওদের মুখে ছিল একটা চাপা উল্লাস। ওরা হাসাহাসি করছিল। আক্রান্ত যুবকেরা যখন যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠছিল, ওরা তখন চিৎকার করে এদের ভয় দেখাচ্ছিল। টানা দেড়ঘণ্টা ধরে এই মারধোর চলতে থাকে। উন্মত্ত হামলাবাজেরা পুরো ঘটনাটাকে ভিডিও করে তুলে রাখছিল। পরে ‘গো-মাতা’-কে অসম্মান করার শাস্তির দৃষ্টান্ত হিসেবে তা প্রদর্শন করা হয়।

          উনা শহরে আনার জন্য চারজন যুবককে যখন গাড়িতে তোলা হচ্ছিল, বালুভাই সেই গাড়িতে উঠতে চেষ্টা করেছিলেন। ওরা তাঁর মাথায় লোহার ডাণ্ডা দিয়ে আঘাত করে। তিনি পড়ে যান। তাঁর স্ত্রী তাঁকে রক্ষা করতে ছুটে এলে তাঁকেও মারধোর করা হয়। শহরে যাওয়ার পথে পুলিশের একটা গাড়ি ওদের থামতে বলে। ওদের সঙ্গে পুলিশের কথা হয়। ওদের গাড়ির নাম্বার ছিল DD 03 F 1294। গাড়ির পিছনে লেখা ছিল, প্রেসিডেন্ট, শিবসেনা, জেলা গির সোমনাথ। চারজন যুবককে ওই অবস্থায় উনা বাসস্ট্যান্ড থেকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে এসে লক আপে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

          আহত বালুভাই  পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রীকে অ্যাম্বুলেন্সে করে উনা শহরের বদলে গির গাধদা শহরে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বালুভাই উনা শহরের হাসপাতালে যেতে চাইলে তাঁকে পুলিশ হুমকি দেয়।

          ইতিমধ্যে উনা শহরের লোকজন জানতে পারে যে চারজন দলিত যুবককে মারধোর করা হয়েছে। তারা একে একে ঘটনাস্থলে এসে জড়ো হয়। লোকজনকে দেখে আক্রমণকারীরা পালিয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যায় জনসাধারণের চাপে পুলিশ এফআইআর নিতে বাধ্য হয়। সেই এফআইআরে যাদের নাম ছিল : ১। উনা তফসিলের সিমার গ্রাম থেকে আসা প্রমোদগিরি রমেশগিরি, ২। উনা শহরের বলবন্ত ধীরুভাই, ৩। উনা তফসিলের সামতের গ্রাম থেকে আসা রমেশ ভগবানভাই, ৪। উনা শহরের ভীমপাড়া থেকে আসা রাকেশ, ৫। ওই পাড়ার রসিক এবং গির গাধদা তফসিলের বেদিয়া গ্রাম থেকে আসা নাগজি দহিয়াভাই আহির।

ইন্টারনেটে ওই ভিডিও ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়। প্রশাসন বাধ্য হয়ে কিছু পদক্ষেপ নেয়। ছয়জন পুলিশ অফিসারকে সাসপেন্ড করা হয় এবং ভিডিও থেকে শনাক্ত করে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকিরা এখনও অধরা।[1]

অন্য এক বিবরণ [2] থেকে জানা যাচ্ছে, ললিতার কথা। ললিতার দেওর ওই চার যুবকের একজন, যাকে সাঙ্ঘাতিকভাবে মাথায় মারা হয়েছিল। ললিতা ক্ষোভের সঙ্গে জানায়, ‘ঘটনার দিনে পুলিশ ঘটনাটা দেখে এবং চলে যায়। আক্রমণকারীরা নিজেদের শিবসেনা গো-রক্ষক হিসেবে দাবি করছিল।’  

   আক্রমণের পর থেকেই গুজরাতে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়। রাজনীতির বড়ো বড়ো মাথারা ঘটনাস্থল সফর করেছে। জাতভিত্তিক বৈষম্য দূর করার প্রতিজ্ঞা করেছে। বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী রাজ্যসভায় জ্বালামুখী বক্তৃতা করেন। মিডিয়ার ক্যামেরা উন্মাদের মতো ওই ঘটনাগুলোকে মুখ্য সময়ের চমক লাগানো মজার দৃশ্য হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে।

ছোট্ট একটা গ্রাম মোটা সমাধিওয়ালা। দুদিকে না-বাঁধানো মাটির রাস্তা, মাঝখান দিয়ে জঞ্জালের একটা ধারা বয়ে চলেছে। খুব অল্পসংখ্যক পুলিশ অফিসার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যাতে ‘পরিস্থিতি শান্ত থাকে আর কোনো ঘটনা হাতের বাইরে না চলে যায়’!

          আক্রান্তদের মধ্যে দুজন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। অন্যরা মের‍্যদণ্ড আর পিঠে ভয়ানক আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। শরীরের নানান জায়গায় ক্ষত হয়ে গেছে, সম্ভবত সেগুলো স্থায়ী।

          উনার দলিতেরা কেউই জানে না ‘গো-রক্ষক’ কারা। অনেকেই বলেছে, যারা ‘গো-রক্ষক’ বলে দাবি করছিল, তারা কেউই এই অঞ্চলে থাকে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মারমুখী এত লোকের সমাবেশ এত দ্রুত হল কী করে?

          ললিতা দেখেছে, ‘একটা খোলা টেম্পোতে মৃত গরুটাকে ওরা দেখতে পায়। যারা গরু নিয়ে যাচ্ছিল, তাদের ওরা প্রথমে ভয় দেখায়। যখন এরা বলে যে এই কাজটার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই, তখন ওরা মোবাইল ফোনে বেশ কিছু লোককে ডেকে নেয় এবং এইভাবে জমায়েতটা তৈরি হয়। ... অন্যায় মনে করলে ওরা তো পুলিশ ডাকতে পারত। তার বদলে গরু মারার অভিযোগে ওরা আমাদের গায়ে হাত তুলতে থাকে। এটার কি কোনো দরকার ছিল? আমাদের লোকেরা তো তাদের কাজই করছিল।’

    ললিতার দশ বছরের ছেলে মনীশ। সে সব সময় খালি পায়ে লাফ দিয়ে চলে। গ্রাম জুড়ে যা চলছে সেটা দেখাতে সে খুব অধীর। হঠাৎ তাদের ঘিরে এত ক্যামেরা, এত ‘মোবাইল ধরা মানুষ’ আর আলোর ঝলকানি দেখে সে উত্তেজিত! এখন এই গ্রামে এত গুরুত্বপূর্ণ মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে, মনীশ তাদের গাইড বনে গেছে। এতে তার স্কুল কামাই হচ্ছে।

          মনীশ আতঙ্কিত স্বরে বলে, ‘ওরা আমার জ্যাঠাকে মেরেছে। তাদের ওরা শেকল দিয়ে বেঁধে ফেলে। ওরা চাইছিল সমস্ত উনা শহরে ওদের হেঁচড়ে হেঁচড়ে ঘোরাতে।’ মনীশ চাবুক মারার ঘটনাটা অভিনয় করে দেখায়। তার স্কুলের খাতার পাতায় পাতায় ‘জয় ভীম’ শব্দটা সে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লিখে রেখেছে।

          ওরা তোমার জ্যাঠাদের মারল কেন? --- ‘আসলে আমরা একটা ফার্মে কাজ করি। এলাকার লোকেরা আমাদের মৃত পশুর লাশ তুলে নিয়ে আসার জন্য ডাকে। যদি দরকার পড়ে, আমরা জায়গাটাও সাফ করি। এটাই তো আমার জ্যাঠা করছিল। তার জন্য গো-রক্ষকেরা তাকে মারে’, মনীশ বলে।

          মনীশ এরপর সাংবাদিককে হজ্জানবেন চামারের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে এক বৃদ্ধা বসে আছেন বারান্দায়। তাঁর গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। চামড়ার ওপর সবুজ উল্কি আঁকা রয়েছে। হজ্জানবেন বলেন, ‘উনাতে ওরকম মারধোর করার পর শহরে একটা মিছিল বেরোল। ওখানে বাবাসাহেব আম্বেদকরের একটা আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। আমার বড়ো ছেলে রাজু এক বোতল অ্যাসিড নিয়ে মিছিলে গিয়েছিল। ও চারপাশে যা চলছে দেখছিল আর খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। হাফ লিটারের বোতলটা থেকে ও হঠাৎ অ্যাসিড গলায় ঢালতে থাকে। বোতলটাতে মাত্র কয়েক চামচ অ্যাসিড অবশিষ্ট ছিল।’

          সেইদিন থেকে কেঁদেই চলেছেন হজ্জানবেন। গত সপ্তাহ থেকে পুলিশ আর মিডিয়া ওঁর উনার বাড়ি ঘিরে রেখেছে। ওঁর ভাইপোর কিশোর বয়সি ছেলে অশোক ঘটনার দিন মার খেয়েছিল। হজ্জানবেন ওকে দেখিয়ে বললেন, ‘ও একজন মজদুর। ও স্কুলে যায় না। আমরা কী করব? দিনমজুরি করে ও যা নিয়ে আসে তাই দিয়ে আমরা পেট ভরানোর চেষ্টা করি। ও ওইদিন সবার সাথে ঠিকা মজদুরি করতে গিয়েছিল ...।’ কান্নায় ভেঙে পড়ায় তাঁর কথা অসমাপ্ত থেকে যায়।

          হজ্জানবেনের কাছেই তাঁর ভাই উপস্থিত ছিল। সে তার ছানিতে ঢাকা চোখ হাতের পাতা দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। সে কাঁদছিল। ‘(অশোক) ওইদিন কাজ করে সন্ধ্যায় বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত আমরা জানতেই পারিনি কী ঘটেছে। একটা ছেলে চলে যাওয়ার পথে। আর এই নাতি সারা জীবন কষ্ট পাবে, তাকে ভুগতে হবে ওই মার খাওয়ার জন্য’   --- বলতে বলতে সে স্তব্ধ হয়ে যায়।

            রাজুভাই এখন জুনাগড় সিভিল হাসপাতালে ভর্তি। অ্যাসিডে তার শরীরের ভিতরটা ক্ষয়ে গেছে। হজ্জানবেন বলতে থাকেন, ‘তিনটে হাসপাতাল চিকিৎসা না করে ওকে (রাজুকে) ফিরিয়ে দিল। তাদের কাছে সেরকম ব্যবস্থা নেই। ... আজ কয়েক সেকেন্ড তার জ্ঞান এসেছিল। ... তুমি অ্যাসিড জানো না? বাথরুমে এটা ঢাললে কীরকম বুদবুদ ওঠে। তাহলে কল্পনা করো ওর শরীরে কী হয়েছে।’ এই প্রশ্নের জবাব সাংবাদিকের কাছে নেই। 

            ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর থেকে গ্রামে সার্কাসের মতো তাঁবু খাটিয়ে সাংবাদিকেরা অবস্থান করছে। ললিতা সেখানে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, ‘ঘটনার পর পুলিশ আমাদের কাজ বন্ধ রাখার কথা বলেছে। আমরা বলেছি, আমাদের পাঁচ বিঘা করে জমি দাও, আমরা চাষ করব, বন্ধ করে দেব আমাদের কাজ। আমাদের জমি দাও, আমরা খাদ্যশস্য ফলাব। সেই খাদ্য খাব। আমাদের আর এই কাজ করার কোনো প্রয়োজন নেই। এই কাজ করে আমরা আর এরকম বিপদে পড়তে চাই না। আমরা এই কাজ কখনোই করব না।’            

গাই কা দূম আপ রাখো, হামেঁ হামারি জমিন দো
গরুর ল্যাজ তুমিই রাখো, আমাকে আমার জমি দাও
১৮ জুলাই ২০১৬ রবিবার। উনার ঘটনার প্রতিবাদে রাজুভাই অ্যাসিড পান করেছিল। জুনাগড় সিভিল হাসপাতাল থেকে আমেদাবাদ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার পর এইদিন সে মারা যায়। এই ঘটনায় হাজার হাজার দলিত বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মিছিল করে এসে তারা সুরেন্দ্রনগর জেলা কালেক্টরেট অফিসের সামনে এবং চারপাশে দুই ট্রাক ভর্তি গরুর লাশ এনে জড়ো করে। সুরেন্দ্রনগর জেলার নবসরজন ট্রাস্টের কর্মী নাথুভাই পারমার একাই ২৫টা গরুর লাশ নিয়ে এসেছিল। সে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দলিতদের ওই ভিডিও দেখিয়েছে, যেটা ১১ জুলাইয়ের হামলাবাজেরা দলিতদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তুলেছিল। নাথুভাই নিজের ল্যাপটপে ভিডিওটা সেভ করে রেখে দিয়েছিল। ওটা দেখে লোকে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। তারা নাথুভাইকে চাঁদা দিয়ে সাহায্য করে এবং সুরেন্দ্রনগরের বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেয়। একা নাথুভাই ১৫০০ দলিতকে মিছিলে নিয়ে এসেছিল। কালেক্টরেট অফিসের সামনে আওয়াজ ওঠে , ‘গরুর ল্যাজ তুমিই রাখো, আমাকে আমার জমি দাও!’ এর প্রভাব সুরেন্দ্রনগরের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ডজন ডজন গরুর লাশ খোলা জায়গায় পড়ে থাকতে দেখা যায়, কোনো চামার সেগুলো ওঠাতে যায়নি। মিছিলে শামিল জনতা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ‘আমরা দীর্ঘ সময় ধরে প্রতারিত হয়েছি। আর নয়! মৃত পশুর সঙ্গে যুক্ত এই পেশা আমরা ছেড়ে দেব। আমরা ওদের এবার উচিত শিক্ষা দেব। গো-রক্ষকেরা আমাদের মেরেছে এই বলে যে গরু ওদের মা। তাই যদি হয় তাহলে গরুর দেখভাল ওরাই করুক। গরু মরে গেলে ওদেরই তার ব্যবস্থা করতে হবে।’

            দলিতেরা মৃত গরু ওঠানোর যে কাজটা এতদিন করে এসেছে, সেটাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু ব্যবসা চলে। আমেদাবাদে কারখানায় কারখানায় গরুর চর্বি থেকে সাবান তৈরি হয় আর চামড়াটা চলে যায় চেন্নাই ও কলকাতায়।

            সুরেন্দ্রনগর জেলার লিম্বি বিকাশখণ্ডে একটা গোশালা আছে। সেখানে কয়েকদিনের মধ্যে ২০টা গরুর মৃত্যু হল, কিন্তু কেউ সেই লাশ ওঠাতে গেল না। রতনপুর এলাকায় তিনটে গরু মারা পড়ল, কেউ গেল না সেখানে।

            গুজরাতে লক্ষ লক্ষ দলিতের জীবিকা এই পেশা। এছাড়া বহু ব্যবসায়ী এর সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু গো-রক্ষক আর পুলিশের উৎপীড়নে তারা অতিষ্ঠ। চামার সম্প্রদায়ের মানুষ সাধারণত গরিব। তারা গরুর মাংস শুকিয়ে ঘরে রেখে দেয়। সারা বছর সেটা খাওয়া যায়। গরুর চর্বি থেকে যে তেল পাওয়া যায়, সেটাও রান্নায় ব্যবহার হয়।

            ১৯ জুলাই ধোরাজী তালুকের পরাবাড়ি গ্রামের তিনজন যুবক বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এদের মধ্যে ২৫ বছর বয়স্ক যোগেশ হীরাভাই সোলাঙ্কিকে আমেদাবাদ সিভিল হাসপাতালে মাঝরাতে এনে ভর্তি করা হয়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মারা যায়। একই সময়ে মোরভি জেলার ২০০ জন দলিত যুবক বন্দুকের লাইসেন্সের জন্য দরখাস্ত করে।  

 

সবরমতী থেকে উনা দীর্ঘ পদযাত্রা
৩১ জুলাই আমেদাবাদের সবরমতীর আছের ময়দানে বিশ হাজার মানুষের এক সমাবেশে দলিতেরা প্রতিজ্ঞা করে, বহু শতাব্দী ব্যাপী চলে আসা প্রথা, পশুদের মৃতদেহ সরিয়ে ফেলা এবং সাফাই করার কাজ তারা বন্ধ রাখবে। এই প্রথম গুজরাতের ৩০টি দলিত সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয় এবং ‘উনা দলিত অত্যাচার লাদাত সমিতি’ গড়ে ওঠে। গুজরাত সরকারের কাছে রাজ্যের দলিত নেতারা একটা সতর্কবার্তা পাঠায়, সরকার যদি দলিতদের ওপর অত্যাচার বন্ধ না করে, তাহলে ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তারা তাদের নিজ শক্তি প্রদর্শন করবে। দলিত লেখক অম্রুতলাল মাকওয়ানা সমাবেশে ঘোষণা করেন, ‘দাসী জীবন শ্রেষ্ঠ দলিত সাহিত্যকর্ম পুরস্কার’ তিনি সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেবেন।

            উনা দলিত অত্যাচার লাদাত সমিতির আহ্বায়ক তরুণ আইনজীবী জিগনেশ মেভানি বলেন, ‘আমরা খুশি, সারা রাজ্য থেকে কত মানুষ এই সমাবেশে এসেছে। এমনকী যেসব অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকেও বহু মানুষ এসেছে। ... কতজন এসেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সবার রয়েছে এক আত্মবিশ্বাস, আগে যা কখনো দেখা যায়নি। আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলছি, সমস্ত হৃদয় দিয়ে কথা বলছি।’ 

            ৫ আগস্ট সবরমতী থেকে শুরু হয় দলিতদের ‘আজাদি কুচ’ বা স্বাধীনতার পদযাত্রা। রাজধানী আমেদাবাদ থেকে ৩৫৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ৭০ জন দলিত যুবক-যুবতী দক্ষিণ গুজরাতের উনা শহরে পৌঁছায় ১৪ আগস্ট। ১৫ আগস্ট সেখানে জাতীয় পতাকা তোলা হয়। প্রত্যেক গ্রাম থেকে দলে দলে বধূরা রঙিন শাড়ি পরে, যুবতীরা সালোয়ার-কামিজ পরে আর ছেলেরা শার্ট-প্যান্ট পরে পদযাত্রীদের অভ্যর্থনা জানায়। এক-এক গ্রামে সেই পদযাত্রা হাজার হাজার দলিতের সমাবেশে পরিণত হয়। মেয়েদের গানে উচ্চারিত হয় দলিতদের যুগ-যুগান্তের কান্না আর প্রতিবাদের সুর। আওয়াজ উঠতে থাকে, ‘গাই কা দূম আপ রাখো, হামেঁ হামারা জমিন দো’।

            এই জমির অর্থ হল, গুজরাতের ১.৬৪ লক্ষ একর উদ্বৃত্ত সরকারি জমি, যা আয়তনে আমেদাবাদ শহরের তিন গুণেরও বেশি। এই জমি রাজ্যের আইন অনুযায়ী ৩৭,০০০ ভূমিহীন দলিতের প্রাপ্য। জিগনেশ মেভানি বিশদে জানান, তিনি নিজে তথ্য-জানার-অধিকার আইনে একটা দরখাস্ত করেছিলেন। তাতে জানা যায়, ৩৭,০০০ জনের মধ্যে অর্ধেক দলিতও সেই জমি পায়নি। অথচ কাগজে-কলমে জমি হস্তান্তর হয়ে গেছে! উচ্চবর্ণের লোকেরা সেই জমি হাতিয়ে নিয়েছে।

            দশ দিনের পদযাত্রায় উঠে আসে আরও অনেক কথাই। বাস্তবে আমেদাবাদের সমাবেশ থেকেই প্রথম দলিতেরা নিজেদের কথা বলতে শুরু করে। গুজরাতে ৭% দলিত, একদম কদাচিৎ তাদের কন্ঠস্বর শোনা গেছে। এই প্রথম তাদের মনের সব যন্ত্রণা, রাগ কথা হয়ে, গান হয়ে, শ্লোগান হয়ে প্রকাশিত হতে থাকে।

            যুবকদের মধ্যে থেকে শোনা যায়, ‘সরকারকে আমরা বলছি, আমাদের অস্ত্র রাখার অনুমতি দেওয়া হোক। ... উচ্চবর্ণরা, শোষকেরা যদি আমাদের ওপর অত্যাচার করে, আমরা ওদের হাত ভেঙে দেব, পা ভেঙে দেব’। যারা বয়স্ক, তাদের কেউ কেউ বলেছে, ‘আমরা যা করার আইনসম্মত শান্তিপূর্ণভাবে করব’।

            দলিতদের এই উত্থানের অবসরে মিডিয়ায় উঠে আসতে থাকে নানা তথ্য। ইন্ডিয়াস্পেন্ড-এর এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড’ অনুযায়ী ২০১৪ সালে দেশে তফসিলি জাতির ওপর যে অপরাধগুলি সংঘটিত হয়েছে, তার মাত্র ৩.৪%-এর শাস্তি হয় গুজরাতে। অথচ জাতীয় স্তরে শাস্তির হার ২৮.৮%। এই মুহূর্তে এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সৌরাষ্ট্রের রাজুলা গ্রামের এক ট্যানারিতে গো-হত্যার শাস্তিস্বরূপ দলিতদের চাবুক মারা হচ্ছে।

১৯৮১ সালে দলিতদের সাক্ষরতার হার ছিল ২১%, ১৯৯১ সালে হয়েছে ৩৭% আর ২০১১-তে বেড়ে হয়েছে ৬৬%। জিগনেশ মেভানির মতো ছেলেমেয়েরা আজ দলিতদের ঘরেও রয়েছে। বহু শতাব্দী ব্যাপী কায়েম অপমান আর লাঞ্ছনা তারা মুখ বুজে মেনে নেবে কেন?

১৫ আগস্ট সকালবেলায় হাজার হাজার দলিত পদযাত্রীদের সঙ্গে উনা শহরে মিলিত হয়। ভাষণ ও সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে দশ দিনের পদযাত্রার সমাপ্তি ঘটে।

দলিত প্রশ্নে সংলাপের জন্য কিছু কথা

আমাদের জাতি গঠনের মধ্যে একটা দ্বৈততা ছিল। একদিকে শুধুমাত্র বিজ্ঞানভিত্তিক মননশীলতায় স্পষ্ট, শুধুমাত্র রাষ্ট্রের পরিচয়ে চিহ্নিত, আত্মপরিচয়ের দাবি, অন্যদিকে জাতি-বর্ণ-ধর্ম-ভাষা-অঞ্চলের নানা ছোটো-বড়ো পরিচয়। এই দুই পরিচয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব, টানাপোড়েন --- পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্ব নিয়ে টানাপোড়েন স্বাধীনতার আগেও যেমন ছিল, আজ একবিংশ শতাব্দীর আণবিক বোমার ক্ষমতায় বলবান আধুনিক ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-তেও রয়ে গেছে একদম বহাল তবিয়তে। রাজনৈতিক দলগুলি বেশিরভাগই এক অখণ্ড ভারতবর্ষের মহামায়া সৃষ্টি করে ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের সেই শৈশবকাল থেকে বিদ্যমান খণ্ড খণ্ড পরিচয়কে কখনো পুষ্ট করে, কখনো দমন করে তাকেই ব্যবহার করে চলেছে।

          হিন্দু ধর্মের যে বৈচিত্র্য, তার নানারকম পরস্পর বিরোধিতা, সমাজ সম্পর্কে তার নানান দৃষ্টিভঙ্গি। ধর্মের মধ্যেই অত্যাচার করা আর অত্যাচারিত হওয়ার নানান বয়ান, নানান পুরাণ-কথা, মহাকাব্যগুলির নানা অনুষঙ্গ বারবার এসেছে বর্ণ বিচার আর জাত বিচারের মধ্যে। শুধুমাত্র জন্মগত কারণে যুগের পর যুগ এক ধরনের মানুষ নিম্নজাতি হিসেবে পরিচিত হতে থাকবেই আর তাদের পরিশ্রমের ফসল জন্মগত কারণে বংশ পরম্পরায়, যুগের পর যুগ আরেকদল উপভোগ করে চলবেই। এই ব্যবস্থার স্থায়িত্বের জন্য উচ্চবর্ণরা প্রায় সমস্ত দেশ জুড়েই ধর্মের এক ধরনের অনুশাসনকে কাজে লাগিয়ে এসেছে। পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতাতে নানারকম বিভাজিত শ্রেণী অবস্থান, শ্রেণী শোষণ থাকলেও যুগ যুগ ধরে জন্মের অভিশাপে অভিশপ্ত, জীবন ব্যাপী শুধু অপমান আর অত্যাচার প্রাপ্তির উদাহরণ বোধ হয় আর হয় না।

          আমাদের জাতি গঠনে যে স্বপ্ন আঁকা হচ্ছিল, তার মধ্যে এই পদদলিত জাতির কথা থাকেনি। থাকেনি উচ্চবর্ণের অপ্রতিহত অত্যাচারের বিরুদ্ধে সতর্কতা। সমস্ত বিভাজনকে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছিল কৃত্রিম জাতীয়তাবাদের এক খোলসের মধ্যে।

          যারা সাম্যবাদী, ভারতবর্ষকে অন্যভাবে ভাবার সম্ভাবনাকে উন্মুখ করে তুলেছিল যেসব সচেতন মানুষ, তারা কিন্তু ভারতবর্ষের নির্মম নির্দয় জাত বিরোধ আর উচ্চবর্ণের স্বরূপ জানতে পারলেও বুঝতে পারেনি। অর্থনীতির বর্গ অনুসারে বিচার করতে করতে হারিয়ে ফেলেছিল সমাজের স্বরূপের মধ্যে, সংস্কৃতির মধ্যে আর প্রতিদিনের আচার-বিচারের মধ্যে থেকে যাওয়া শোষণের আরও আরও মাত্রার বোধ। তাদের মতাদর্শের অন্ধতার জন্যই তারা এটা বুঝতে পারেনি।

          প্রথমে ভক্তি আন্দোলনের মধ্যে একটা অস্বীকার ছিল মধ্য যুগ থেকে। জাত বিরোধী আবেগ ছিল। সব মানুষকে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে দেখে জাত বিভাজনকে অস্বীকার করা হচ্ছিল। পরবর্তীকালে উচ্চবর্ণের সংস্কৃতি এই ধারাকে নিজের মধ্যে অনেকখানি আত্তিকরণ করে নিলেও লৌকিক কণ্ঠে আউল-বাউল-সুফি-মরমিয়াদের গানে-সাধনায়-জীবনচর্যায় সেই নিষ্ঠুর বিভাজনকে অস্বীকার করা চলছেই। লৌকিক ধর্ম দলিত মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল।

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন কয় জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।

          এই অস্বীকার থেকে জন্ম নিতে থাকে এক সামাজিক ক্রোধ। এই ক্রোধের ভাষা কণ্ঠে তুলে নেন দক্ষিণ ভারতের পেরিয়ার, পশ্চিম ভারতে জ্যোতিরাও গোবিন্দরাও ফুলে এবং আরও অনেকে। কিন্তু বাবাসাহেব আম্বেদকর প্রথম সমস্ত নিপীড়িত দলিতদের অধিকার নিয়ে জাতি গঠনের প্রক্রিয়াতে দলিতদের প্রশ্নকে সংশ্লিষ্ট করতে চাইলেন। এই দলিতদের কথা তৎকালীন সমস্ত রাষ্ট্রনেতারই বিস্মরণ ঘটেছিল। এই প্রশ্নে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে টানাপোড়েন, বাক-বিতণ্ডা, তর্ক শুরু হল, তার থেকে কোনো সচেতন মানুষ, কোনো বিশিষ্টজন, কোনো দেশবাসী বাদ গেল না। ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজের একতার এক গল্পগাথার মধ্যে নিজেকে ঐক্যবদ্ধ হিসেবে তুলে ধরার যে চেষ্টা চলছিল, তা বিখণ্ডিত হয়ে আপন স্বরূপকে উন্মোচিত করে দিল। আম্বেদকর পুনা প্যাক্টের বিমূঢ়তা থেকে ক্রমশই হয়ে উঠলেন সারা ভারতের দলিতদের একমাত্র কণ্ঠস্বর। ভারতের সংবিধান রচনার অন্যতম ব্যক্তিত্ব, ভারতবর্ষের প্রথম আইনমন্ত্রী আম্বেদকর নিম্নবর্ণের সমাজে নিজের ওপর ভর করে উঠে দাঁড়ানোর জন্য আইনি কিছু স্থির ভূমি সংবিধানের মধ্যে দিতে চেয়েছিলেন। এক পশ্চিমি আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তি এক মুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন স্বাধীন ভারতবর্ষকে ঘিরে। আইন অনেকখানিই সচেষ্ট তাঁর পিছিয়ে পড়া মানুষকে ওপরে তোলার তাগিদের জন্য, কিন্তু সমাজ --- শহরের শিক্ষিত আধুনিক নাগরিক সমাজ থেকে গ্রামীণ সমাজ --- তার মননে রেখে দিয়েছিল উচ্চবর্ণের অহঙ্কার, নিম্নবর্ণকে সমাজের সর্বক্ষেত্রে মাথা হেঁট করে রাখার অচলায়তনকে। আম্বেদকর বুঝতে পারছিলেন আইন আর সমাজের এই নিষ্ঠুর বিভাজন, দ্বিচারিতা যেন ভারতবর্ষের এক ভবিতব্য। ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে রাজ্যসভায় তাঁর এই উপলব্ধিকে তিনি প্রকাশ করেন : ‘ভারতের সংবিধান আমরা মন্দিরের মতো তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যেখানে ঈশ্বর এসে অধিষ্ঠান করবেন, কিন্তু তার আগেই শয়তান অধিষ্ঠিত হয়ে গেল।’ তাই নিজেকে সরিয়ে নিলেন আইন মন্ত্রকের মন্ত্রিত্ব থেকে, হিন্দু ধর্ম থেকে, শরণ নিলেন বৌদ্ধধর্মে মৃত্যুর মাত্র একমাস আগে। যে হিন্দু ধর্ম তাদের কোনোদিন রক্ষা করতে পারেনি, মহাকাব্যের শম্বুক থেকে শুরু হয়ে পবিত্র গঙ্গা, কাবেরী দিয়ে স্বাধীন ভারতেও তাদের রক্ত বয়েই চলেছে, সেই ধর্ম থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর হাজার হাজার দলিত দীক্ষিত হল ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে। এই ঘটনা আমাদের জাতীয় ঐক্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করল।

          আম্বেদকর এবং আম্বেদকরকে ঘিরে দলিতদের এই যে স্বপ্ন দেখা আর সেই স্বপ্ন ভেঙে পড়াকে দেখা, এটাই স্বাধীন ভারতের দলিত রাজনীতির বয়ানকে রচনা করে দিয়েছে।

          জাতির ঐক্যকে গড়ে তুলতে জাতীয়তাবাদের নির্মাণে কত প্রতীককেই না গ্রহণ করতে হয়। প্রতীককে সামনে রেখে এক অখিল জাতীয় ঐক্যকে সংগঠিত করার স্বপ্ন রাষ্ট্রনেতারা বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন কালে দেখে এসেছে।। যে দেশগুলির বৈশিষ্ট্যই হল বৈচিত্র্য-বিভিন্নতা, সেইসব দেশের এই প্রতীকগুলি যেমন অনেককেই আকর্ষণ করে, তেমনি বিকর্ষণও করে। কত মানুষ তাই এই প্রক্রিয়ার বাইরেই থেকে যায় অপর হয়ে, কখনো শত্রু হয়ে। ভারতবর্ষের জাতি নির্মাণের সঙ্গে গরুর মাতৃত্ব কীভাবে মিশে যেতে লাগল, সে ইতিহাসবিদদের আলোচ্য বিষয়। কিন্তু কার্যত সেটা হয়েছিল বিশেষত উত্তর ভারতে, যা আজকে গো-বলয় নামে পরিচিত। প্রতিদিনকার নিষ্ঠুর দুগ্ধ দোহন, অস্বাস্থ্যকর স্থানে গরুদের রেখে দেওয়া, ঠিকমতো খেতে না দেওয়ার তাবৎ নিষ্ঠুরতার মধ্যে গরুকে নিয়ে টাকা-সর্বস্ব এক বাণিজ্য প্রক্রিয়া এসব অঞ্চলে চলে। তাকে আড়াল করে এক বিমূর্ত গো-মাতাকে তৈরি করা হল।

          যদিও মহাকাব্য, পুরাণ থেকেই গরু আমাদের সংস্কৃতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল। তাকে মা বলা হয়েছে এইসব প্রাচীন কথায়। আধুনিক যুগেও সাহিত্যে গরু আর মানুষের সম্পর্কের মাধুর্য প্রকাশ হয়েছে। বাস্তবেও হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পোষা গরুকে পরিবারের একজন সদস্যার মতো দেখার দৃষ্টান্ত আমরা জানি। কিন্তু এর মধ্যে হিংসার স্থান কোথায়? পাশাপাশি দুটি প্রাণীর সাহচর্যে যে মাধুর্য সৃষ্টি হয়, এ তাই-ই। হয়তো হিন্দুদের ক্ষেত্রে এতে কিছুটা ঐশ্বরিক মাত্রা যুক্ত হয়েছে মাত্র। এর সঙ্গে বিমূর্ত গো-মাতার কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ ভারতবর্ষকে মিলিয়ে দেওয়া হল এই বিমূর্ত গো-মাতার রূপের সঙ্গে। গো-রক্ষক মানে দেশরক্ষক আর গো-ভক্ষক মানে দেশদ্রোহী! স্বাধীনতার সময় এইসব ভাবনা অল্পবিস্তর ছিল বটে, গরু হত্যা নিয়ে প্রচুর দাঙ্গাও হয়েছে হিন্দু-মুসলমানে আর কিছুটা দলিতদের সঙ্গেও।

          দলিতরা সবাই গো-ভক্ষক না হলেও দলিতদের একাংশ চামারদের জীবন-জীবিকা চলে মরা গরুর চামড়া ছাড়িয়ে। তারা রয়ে গেল বৃত্তের প্রান্তে অথবা একদম বাইরে। গো-রক্ষক সংস্থা ভারতের সংগঠিত স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রায় সমসাময়িক। সমাজের কত নক্ষত্রজন এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এঁদের মনে হিংসা না থাকলেও বিষয়টার মধ্যেই যেহেতু বিরোধের বীজ রয়ে গেছে, তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের গণজোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে গণসমর্থনে পুষ্ট নানা কারণের সঙ্গে এই কারণেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা সমান্তরালভাবে চলেছিল।

          স্বাধীন ভারতে বিশেষ করে আরএসএস-বিজেপির মদতে সব গো-রক্ষক সংস্থার প্রসারণ শুরু হল। উদ্দেশ্য ছিল ‘অপর’দের সবক শেখানো। নির্বাচনে ভোট নিজের পক্ষে টানার জন্য গো-রক্ষকেরা ইসলাম ধর্মের মানুষদের যাবতীয় আইনি-বেআইনি হেনস্থা থেকে শুরু করে প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সংগঠিত করেছে --- নিজেদের গো-রক্ষক, অর্থাৎ হিন্দুধর্ম-রক্ষক, অর্থাৎ দেশ-রক্ষক হিসেবে তুলে ধরার জন্য।

          দিল্লিতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এই ‘গো-রক্ষা’ আন্দোলনের স্রোত এতই তীব্র হয়ে উঠল যে আরএসএস-বিজেপির রণকৌশলে মুখ বুজে মার খাওয়া মুসলমানরাই শুধু লক্ষ্যবস্তু হবে, তাদের হিন্দুভোট অবিভাজ্যভাবে পরবর্তী নির্বাচনেও তাদের ঝুলি ভরিয়ে দেবে, এখানে থামল না। সেই উৎসাহের জঙ্গিপনা প্রসারিত হল তাদের সম্ভাব্য ভোটব্যাঙ্ক দলিত সমাজ পর্যন্ত। হায়দ্রাবাদ থেকে মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র হয়ে গুজরাতেও দলিতদের আক্রমণ করা হল --- মৃত গরুর চামড়া তোলার অপরাধে! আরএসএস-বিজেপির লিখিত হিন্দুত্ব রাষ্ট্রীয় একমাত্রিকতা দিয়ে নির্মিত।  ধর্ম, সমাজ, লোকাচারের যে বৈচিত্র্যের ঐতিহ্য আবহমান কাল থেকে দেশের মননে ক্রয়াশীল, তাকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার জন্যই তাদের কার্যক্রম। সেই কার্যক্রমে মূল লক্ষ্য মুসলমানরা। দলিতদের সঙ্গে ঐক্যের অর্থ ছিল তাদের নিকৃষ্ট কাজে ব্যবহার করা, যা ২০০২ সালের গুজরাতের আগ্রাসি গণহত্যায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে দেখা গিয়েছিল। নির্বাচনের জন্য বন্ধুর মতো ব্যবহারের অভিনয় একটা কৌশল মাত্র, প্রকৃত প্রস্তাবে তা দলিত বিরোধী উচ্চবর্ণের এক কার্যক্রম, ব্রাহ্মণ্যবাদী জীবনদর্শন। আগ্রাসি ব্রাহ্মণ্যবাদ আর এক আগ্রাসি রাষ্ট্রীয় কর্পোরেট মতবাদের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র নির্মাণের পথে।

          এই আগ্রাসি অভিযান ইদানীংকালে প্রথম ধাক্কা পায় রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার ঘটনায়। দলিত এবং তাদের সহমর্মী বুদ্ধিজীবী-ছাত্র-যুবকদের একটা স্পষ্ট প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে। গুজরাতের উনার ঘটনা নিচেরতলার দলিত জীবনযাপনে রত দলিত সমাজের সঙ্গে শিক্ষিত দলিতকূলের একটা সংলাপ রচনা করে, তাৎক্ষণিক একটা সমন্বয়ও গড়ে উঠেছে।

          ভারতবর্ষের প্রবহমান এই ধারাগুলি থেকে অবিভক্ত বাংলা এবং আজকের পশ্চিমবঙ্গও বিচ্ছিন্ন নয়। যদিও এই রাজ্যে আরএসএস-বিজেপির প্রতাপ তুলনায় কম, তবুও উচ্চবর্ণের সর্বক্ষেত্রে উপস্থিতির প্রাবল্য দলিতদের যেন প্রায় অদৃশ্য করেই রেখেছে। যেন দলিত বলে এই রাজ্যে কিছু নেই, শিক্ষাক্ষেত্রে নেই, রাজনীতির মঞ্চে নেই, কর্মক্ষেত্রের সংগঠিত অংশে নেই, শিল্পে নেই, সংস্কৃতিতে নেই। আরও আরও না দিয়ে দলিতদের অদৃশ্য, ‘না’ করে দেওয়া হয়েছে। দলিতরা আছে রাস্তা-নর্দমা সাফ করতে, শবদাহ করতে, পশুপাখির মৃতদেহ সরানোর কাজে, কিছুদিন আগেও মানুষের মল মাথায় করে সরানোর কাজে; তারা আছে ইটভাটাতে, পাথর খাদানে, অসংগঠিত-পরিযায়ী শ্রমিকদের দেশান্তরী অভিযানে, সেই সঙ্গে হয়তো বা কিছু সরকারি কোটায় সরকারি অফিসে, দিন-আনি-দিন-খাই রুজি রোজগারে, খেতে-খামারে। কিন্তু এরা আমাদের কাছে দলিত নয়, ভারতবর্ষে পশ্চিমি সভ্যতার আলোকপ্রাপ্তিতে আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের জোয়ারে শিক্ষার যে ‘পালিশ’ আমরা পেয়েছি, এরা হল ‘ছোটোলোক’! বাংলার উচ্চবর্ণের এক সেকুলার নির্মাণ এই শব্দচয়ণ, যেখানে জাতপাতের গন্ধকে চাপা দেওয়ার এক অদম্য প্রয়াস লক্ষিত হয়েছে।

          আমরা এই ছোট্ট পুস্তিকার মাধ্যমে উনার ঘটনায় লাঞ্ছিত অপমানিত দলিতের প্রতিবাদকে চোখ মেলে দেখতে চেয়েছি। আমরা চাই আমাদের এই জানা ও জানানোর কার্যক্রমের মধ্যে আসুক এই রাজ্যে দলিতদের অবস্থা, তাদের ভালো থাকা, তাদের খারাপ থাকা, তাদের যন্ত্রণা-অপমান-হিংসা। আমাদের চর্চার মধ্যে আসুক রাজনীতির মঞ্চে দলিতদের একাংশের নৈতিক-অনৈতিক নানা কৌশলে ক্ষমতায় উঠে আসা। এই ক্ষমতাক্ষেত্রগুলি দলিতের জন্য মানবতার বন্ধ দরজাকে কতখানি খুলতে পেরেছে আর পারবে?

          আমাদের চর্চার মধ্যে আসুক আমাদের প্রত্যেকের ভিতরের আলো অন্ধকার, আমাদের ভদ্রলোকেদের গর্বের সংস্কৃতি, শিক্ষার অভিমান, আমাদের ভদ্র আচরণ যা দিয়ে নির্মিত হয়েছে বাঙালির আত্মপরিচয়। সেই আত্মপরিচয়ে আমরা কতখানি আদিবাসী, মুসলমান, দলিতদের বাঙালি হিসেবে গ্রহণ করতে পেরেছি আর কতখানি ছোটোলোক বলে দূরে সরিয়ে দিয়েছি?
*           

গাই কা দূম আপ রাখো, হামেঁ হামারি জমিন দো
গরুর ল্যাজ তুমিই রাখো, আমাকে আমার জমি দাও

 


অপমানিত দলিতের উত্থান

লেখক                                                    কাজল মুখার্জি (সমস্ত উদ্ধৃত অংশের বাংলা তরজমা সহ)

প্রকাশকাল                                              ১৫ আগস্ট ২০১৬

প্রকাশক                                                 মন্থন সাময়িকী
প্রযত্নে জিতেন নন্দী
বি ২৩/২ রবীন্দ্রনগর, বড়তলা
কলকাতা ৭০০০১৮
দূরভাষ ০৩৩ ২৪৯১৩৬৬৬
ই-মেল manthansamayiki@gmail.com

মুদ্রণ    প্রিন্টিং আর্ট, ৩২এ পটুয়াটোলা লেন, কলকাতা ৭০০০০৯

মূল্য   ৬ টাকা


 

হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!
             মানুষের অধিকারে
             বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
              বিধাতার রুদ্ররোষে
              দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।   

তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে
সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে।
              চরণে দলিত হয়ে
              ধুলায় সে যায় বয়ে
সে নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ।
অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান। ... ...

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গীতাঞ্জলি, ২০ আষাঢ় ১৩১৭

 



১ এই বিবরণ পাওয়া গেছে ন্যাশনাল হিউম্যান রাইট্‌স কমিশনের কাছে পেশ করা নবসরজন ট্রাস্টের একজিকিউটিভ ডিরেক্টর মঞ্জুলা প্রদীপের নেতৃত্বে অনুসন্ধানকারী দলের প্রতিবেদন থেকে। এঁরা জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে উনা এবং রাজকোটে সরেজমিন সমীক্ষা করেন।

As Dalit Protest in Gujarat Continue, a Look at What’s Behind Them, Suravi Vaya, 27 July 2016.

Frontier
Aug 26, 2016


Manthansamayiki manthansamayiki@gmail.com

Your Comment if any