banner
lefthomeaboutpastarchiveright

শ্রমিক আইন বদল নিয়ে শ্রমিকদের জন্য লেখা

শুভেন্দু দাশগুপ্ত

এই লেখাটা বিলি করার বিষয়ে একটা পদ্ধতি নেওয়া যাক৷ যাদের এই বিষয়টিতে উত্সাহ আছে, তাদেরকে আমি পাঠালাম৷ তারা অন্যদেরও পাঠাতে পারে৷ যাদের যতটা দরকার ছাপিয়ে নিয়ে বিলি করবে৷ দাম নিতে পারে, কিন্ত্ত ছাপার খরচের থেকে বেশি নয়৷ আমি ছাপিয়ে বিলি করছি না৷

শ্রম আইন, শ্রমিকদের বিষয়ে যে সব আইন আমাদের দেশে চালু আছে, ছিল, সে সব এখন বদলানো চলছে৷ বদলানোর প্রস্তাব বানানো হচ্ছে৷ প্রস্তাব গ্রহণ করা হচ্ছে৷ বিভিন্ন রাজ্যে এবং কেন্দ্রে৷

বদলে দেওয়া আইন, যতটা পেরেছি, জোগাড় করার চেষ্টা করেছি৷ তা এক জায়গায় রাখছি৷

প্রথমে একটা একটা করে আইন নিয়ে বলা, সাজানোর কোনও নিয়ম না মেনেই৷

এর পর দেখানো এই সব শ্রম আইন বদলে ফেলার জন্য কী কী যুক্তি সাজাচ্ছে সরকার আর পুঁজিমালিকরা৷

তার পর কথা বলা এর বিরোধিতায় শ্রমিকদের কি করা, তাই নিয়ে৷

১৷ ফ্যাকটরিজ অ্যাক্ট, ১৯৪৮
এই আইনে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, কল্যাণ, নিরাপত্তা, কাজের সময়, ছুটি এমন সব বিষয়ে বেশ কিছু অধিকার দেওয়া আছে৷
এই আইন বদলে দেওয়া হয়েছে৷
ক) বেতন সহ ছুটির দিন কমিয়ে দেওয়া৷ ২৪০ দিন থেকে কমিয়ে ৯০ দিন৷
খ) শ্রমিকদের থাকার জায়গা, বিশ্রাম করার জায়গা, এ সব করার জন্য মালিকের দায়কে কমিয়ে আনা৷ ১৫০ জন শ্রমিকের জন্য ব্যবস্থা করা থেকে কমিয়ে ৭৫ জন শ্রমিকের জন্য ব্যবস্থা করা৷
গ) কাজের সময় বাড়িয়ে দেওয়া৷ একজন শ্রমিকের কাজ ৬০ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা করে দেওয়া৷
ঘ) বাধ্যতামূলক ‘ওভারটাইম’ করার সময় বাড়িয়ে দেওয়া৷ ‘শিফট্ ওয়ারকার’দের বেলায় প্রতি ৩ মাসে ৫০ ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে ১০০ ঘণ্টা করা৷ অন্য শ্রমিকদের বেলায় প্রতি ৩ মাসে ৭৫ ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে ১১৫ ঘণ্টা৷ আর পাবলিক ইউটিলিটি সার্ভিস, মানে সাধারণের জন্য পরিষেবার কাজ ১২৫ ঘণ্টা৷
ঙ) ‘সংগঠিত শিল্প’-এর মানে বদলে দেওয়া৷ আগে কোনও কারখানায় বিদ্যুত্ থাকলে ১০ জন শ্রমিক, বিদ্যুত্ না থাকলে ২০ জন শ্রমিক হলে তা সংগঠিত শিল্পের মধ্যে পড়ত৷ এখন বাড়িয়ে করা হল, বিদ্যুত্ থাকলে ২০ জন শ্রমিক, বিদ্যুত্ না থাকলে ৪০ জন শ্রমিক৷

এর ফলে বিশাল সংখ্যার শ্রমিককে, সংগঠিত শিল্পের আওতার বাইরে, আইনের পরিসরে বাইরে, শ্রমিক-অধিকারের বাইরে নিয়ে যাওয়া৷

নতুন আইনে শ্রমের সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার মানে কাজের সময় বাড়ানো আর বিশ্রামের সময় কমানো, তার ফলে শ্রমজীবন, একজন শ্রমিকের শ্রম করার ক্ষমতাকাল কমে যাওয়া৷ অন্য ভাবে দেখলে একজন শ্রমিকের বিশ্রাম নেবার, পাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া৷

একজন শ্রমিকের কাজের সময় বাড়িয়ে দেওয়া, বাধ্যতামূলক ওভার টাইমের সময় বাড়িয়ে দেওয়া, ছুটির দিন কমিয়ে দেওয়া এই সব বিষয়কে আর এক ভাবে দেখা যায়৷ শ্রমিকদের ‘আট ঘণ্টা কাজের সময়’ একটি ঐতিহাসিক, রাজনীতিক ও সামাজিক বিষয়৷ শ্রমিকদের এই অধিকারটি কঠিন লড়াই করে পাওয়া৷ নতুন আইনে এই ধারণাটিকেই, ইতিহাসটিকেই বদলে ফেলা, অস্বীকার করা৷

এই বিষয়টিকেই রাষ্ট্র ও পুঁজির তরফে দেখা হচ্ছে এই ভাবে- বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিযোগিতা ধারণায় একটা ঠিক করে রাখা, থাকা কাজের সময় খাপ খায় না৷ পুঁজির প্রতিযোগিতা ধারণায় রয়েছে শুধু মুনাফার নিরিখ৷ সেখানে একজন শ্রমিকের কাজের একটা নির্দিষ্ট ঘণ্টার ধারণা বাতিল করে দিতে হবে৷ শ্রমিকের কাজের ঘণ্টার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মালিকের মুনাফা, পুঁজির ক্ষমতা৷ তাই রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত শ্রমকে পুঁজির প্রয়োজন মাফিক ব্যবহার করা হবে৷

chhobi-1
ছবি ১। বেত বোনার কারিগর, চিত্তপ্রসাদ, ১৯৫৮

ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার পুঁজি আনার প্রতিযোগিতায় শ্রমের সময়ের ওপর শ্রমিকের অধিকার সরিয়ে দিয়ে মালিকের অধিকার বানানোর আইন তৈরি করেছে, করছে৷ একজন শ্রমিকের, একদল শ্রমিকের নির্দিষ্ট কাজের সময় বাড়িয়ে দেওয়া মানে, এক দিকে যেমন এখন কাজে থাকা শ্রমিকদের কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়া, অন্য দিকে নতুন শ্রমিকদের, শ্রমের কাজে আসতে চাওয়াদের কাজ পাওয়া কমিয়ে দেওয়া৷ তাদের কাজ পাওয়ার অধিকার অমান্য করা৷

২৷ পেমেন্ট অফ ওয়েজ অ্যাক্ট ১৯৩৬
বর্তমানের পেমেন্ট অফ ওয়েজ অ্যাক্ট অনুযায়ী কারখানা পরিদর্শনের নিয়মরীতি না মানলে, কারখানা পরিদর্শনে আসার সুযোগ তৈরি না করে দিলে মালিকদের জরিমানা দিতে হত৷
নতুন আইনে, পরিদর্শকের নাম ও মানে বদলে দেওয়া হয়েছে৷ এখন নাম ‘ইন্সপেক্টর’ বদলে দিয়ে ‘ফেসিলিটেটর’৷ কারখানা পরিদর্শকের বদলে সহায়ক৷ ফেসিলিটেটর আইনের ধারাগুলিকে ভালো ভাবে প্রয়োগ করার জন্য মালিক ও শ্রমিকদের তথ্য ও পরামর্শ দেবে৷

পরিবর্তিত আইনে বলা হয়েছে, আইনানুগ ব্যবস্থা নেবার আগে ফেসিলিটেটর কোম্পানিকে একবার সুযোগ দেবে চিঠি পাঠিয়ে৷ যদি মালিক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দেশ মানে তা হলে শাস্তি দেওয়া যাবে না৷

কারখানা পরিদর্শনে যাবার সংখ্যা সীমিত করে দেওয়া হবে৷ পরিদর্শনে যাবার জন্য উচ্চতর কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে৷

লেবার কমিশনারের ক্ষমতাকে সরিয়ে দিয়ে এক বা একাধিক কর্তৃপক্ষের হাতে তা তুলে দেওয়া হবে৷ এবং এই কর্তৃপক্ষের চেহারা কি তা বলা হয়নি৷

৩৷ মিনিমাম ওয়েজেস্ অ্যাক্ট, ১৯৪৮
বদলে নেওয়া আইনে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করার জন্যে কোনও মাপকাঠি থাকবে না৷ পঞ্চদশ লেবার কনফারেন্সে ন্যূনতম মজুরি সম্পর্কে যে সুপারিশ ছিল, যাকে পরে সুপ্রিম কোর্ট আরও উন্নত করেছিল, নতুন আইনে তা বাতিল করা হয়েছে৷

বদলে দেওয়া আইনে বলা হয়েছে, ন্যূনতম মজুরি রাজ্য সরকার ঠিক করবে৷ এর আগে শ্রমিকদের তরফে বার বার আলোচনা করা হয়েছে, প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় স্তরে ‘স্ট্যাটুটরি ন্যাশনাল ফ্লোর লেবেল মিনিমাম ওয়েজ’, মানে জাতীয় ভাবে বাধ্যতামূলক ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা৷ রাজ্য সরকারগুলি এই ন্যূনতম মজুরির ওপর মজুরি ঠিক করতে পারবে, এর নিচে নয়৷ এর ফলে সবার জন্য ন্যূনতম মজুরির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাবে৷ এটি অস্বীকৃত হল৷

বিভিন্ন রাজ্যে সরকারের ‘ওয়েজ বোর্ড’ কার্যকর নয়, ফলে নতুন আইনে থাকা প্রস্তাব শ্রমিকদের পক্ষে যাবে না৷ শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পাবার অধিকার অস্বীকার করা হলো৷
কেন্দ্রীয় সরকার মজুরি ঠিক করার দায়িত্ব নিল না৷ অথচ মজুরি ঠিক করা যে যে উপাদানের উপর নির্ভর করে যেমন, খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, পোশাক, এই ধরনের সব কিছু কেন্দ্রের দায়িত্বে৷

৪৷ পেমেন্ট অফ বোনাস অ্যাক্ট, ১৯৬৫
আইনে ছিল কোম্পানির হিসাবপত্র, অডিটেড অ্যাকাউন্টস ও ব্যালান্সশিট দেখা, দেখতে চাওয়া শ্রমিকদের অধিকার৷ যাতে মালিকের কাছে দাবি পেশ করার সময় তথ্য দেখানো ও যুক্তি বানানো যায়, রাখা যায়৷

পরিবর্তিত আইনে এই অধিকার দেওয়া নেই৷ ফলে মালিকের কথাকে বিরোধিতা করার সুযোগ শ্রমিকদের কমে গেল৷ শ্রমিকরা তথ্য পাবার অধিকার হারালো, ফলে দর কষাকষির অধিকার হারালো৷ তাদের শ্রমে তৈরি মালিকের মুনাফায় ভাগ বসানোর, মানে বোনাস পাবার অধিকার হারালো৷

বদলে দেওয়া আইনে বলা হয়েছে, ‘নতুন বানানো’ কোম্পানিকে শ্রমিকদের বোনাস দিতে হবে না৷ এর ফলে একটা কোম্পানি চাইলে তাদের জায়গা, প্রশাসন, নাম, মালিকানা বদলে বদলে সব সময় ‘নতুন’ কোম্পানি হয়ে থেকে যেতে পারবে, ফলে বোনাস দিতে হবে না, বোনাস দেওয়া এড়িয়ে যাওয়া যাবে, এই ভাবে শ্রমিকদের বোনাস পাবার অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো৷

৫৷ ইন্ডাসট্রিয়াল ডিসপিউটস্ অ্যাক্ট, ১৯৪৭
এই আইনটি শ্রমিক ছাঁটাই, কারখানায় লে অফ, ক্লোজার ঘোষণা বিষয়ে৷

এই আইন অনুযায়ী একটি কোম্পানিকে শ্রমিকদের ছাঁটাই করার জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়৷ যদি শ্রমিক সংখ্যা ১০০ থাকে, তা হলে অনুমতি নিতে হতো না৷ নতুন আইনে এই সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০০ জন শ্রমিক৷ আইন বদলে দিয়ে শ্রমিকের অধিকার ও মালিকের অধিকারকে বিপরীত করে দেওয়া হলো৷ শ্রমিক আন্দোলনের নানা ধরণ, গো স্লো, ওয়ার্ক টু রুল, এই সবের অধিকারকে ধরা হবে অসদাচারণ, লে অফ করাকে ধরা হবে ঠিক কাজ, আইনী কাজ, মালিকদের অধিকার৷

শ্রমিকদের প্রতিবাদে কারখানা বন্ধ করে দেবার পদ্ধতি স্ট্রাইকের সঙ্গে মালিকদের শ্রমিক আন্দোলনের বিরোধিতায় কারখানা বন্ধ করে দেবার পদ্ধতি লক আউটের মধ্যে রাষ্ট্র পক্ষপাতিত্ব করবে৷ রাষ্ট্রের কাছে স্ট্রাইক বেঠিক কাজ, লকআউট ঠিক কাজ৷

chhobi-2
ছবি ২। খনি শ্রমিক, চিত্তপ্রসাদ, ১৯৫১

৬৷ লেবার লস্ (এগজেমশন ফ্রম ফার্নিশিং রিটার্নস অ্যান্ড মেনটেনিং রেজিস্টারস বাই সার্টেন এসস্টাবলিশমেন্টস্) অ্যাক্ট, ১৯৮৮
এতদিনকার আইনে ‘খুব ছোট সংস্থা’ যাদের কর্মী সংখ্যা ১০-এর নিচে এবং ‘ছোট সংস্থা’ যাদের কর্মী সংখ্যা ১০ থেকে ১৯ জন, এদের ছাড় দেওয়া হয়েছিল রেজিস্টার রাখা এবং নয়টি শ্রমিক আইন সংক্রান্ত আলাদা আলাদা রিটার্ন (তথ্য) দাখিল করা থেকে৷ বদলে একটি মাত্র রিটার্ন দাখিল করা৷

বদলে দেওয়া আইনে ‘ছোট সংস্থা’র মানে পাল্টে দেওয়া হয়েছে৷ ‘ছোট সংস্থা’ বলতে বোঝানো হবে ৪০জন শ্রমিক আছেন এমন সংস্থা৷ এবং এদের বেলায় আলাদা আলাদা রিটার্ন দাখিল করা থেকে ছাড়ের তালিকায় আগের ন’টি আইনের সঙ্গে আরও সাতটি আইন যোগ করে মোট ষোলোটি আইন করা হল৷

৪০ জন শ্রমিকের কারখানা মানে বেশির ভাগ ছোট ও মাঝারি কারখানা৷ তারা আইন ও নজরদারির আওতা থেকে বাদ গেল৷ শ্রম আইনকে অমান্য করতে দেওয়া হলো৷ এবং শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকারকে অস্বীকার করতে দেওয়া হলো৷

৪০ জন শ্রমিক কাজ করেন এমন কারখানা উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে উত্পাদনের যুগে ‘ছোট সংস্থা’ নয়৷ অথচ ‘ছোট’ বানিয়ে দিয়ে বোনাস আইন, শ্রম বিরোধ আইন ইত্যাদি আইনের, আইনের প্রয়োগের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো৷

তথ্য জানার জন্য, আরটিআই, রাইট টু ইনফরমেশন, তথ্য জানার অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্য জানা যাবে না৷ কারণ এদের তথ্য রাখা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে৷ শ্রমিকরা দরকারে কোনও প্রমাণ দাখিল করতে পারবেন না৷ যেমন, তিনি কারখানাটিতে কত বছর কাজ করছেন, অবসরের সময় তার কত পাওনা, ইত্যাদি৷

এই সব কারখানায় পেমেন্ট অফ বোনাস অ্যাক্ট ১৯৬৫ প্রয়োগ করা হবে না৷ আগে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বোনাস দেওয়া হতো৷ এখন দেওয়া হবে বড়ো জোর ৮.৩৩ শতাংশ৷

কোনও অভিযোগ থাকলে তা বিচার করবে লেবার কোর্ট ট্রাইবুনাল অথরিটি৷ পরে যদি আপিল করতে হয় তা করতে হবে লেবার কমিশনারের কাছে৷ তার মানে বিষয়টিকে বিচার ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে প্রশাসন-এর কাছে নিয়ে যাওয়া হলো৷ আর এত দিনে জানা হয়ে গেছে প্রশাসন সরকারের কাছে মাথা নামিয়ে রাখে, তারা সরকারের বিরোধিতা করে না৷

৭৷ অ্যাপ্রেনটিসেস্ অ্যাক্ট, ১৯৬১
‘শ্রমিক’-এর মানে বদলে দেওয়া হয়েছে৷ আগে শুধু স্থায়ী শ্রমিকদের ‘শ্রমিক’ বলে ধরা হতো৷ এখন ঠিকাদারের  মাধ্যমে নিযুক্ত ঠিকা শ্রমিককেও ‘শ্রমিক’ বলে ধরা হবে৷ আগে একটি কারখানায় শিক্ষানবীশ (অ্যাপ্রেনটিস) শ্রমিকের সংখ্যা ঠিক করা হতো স্থায়ী শ্রমিক: শিক্ষানবীশ শ্রমিক অনুপাতের হিসেবে৷ এখন স্থায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো, বা তাদের মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়া হলো অস্থায়ী, চুক্তি মাফিক ঠিকা শ্রমিকদের৷ ফলে শ্রমিকের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো যাবে৷ শিক্ষানবীশ শ্রমিক বেশি নেওয়া যাবে৷ যারা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র নয়, তাদেরকেও শিক্ষানবীশ কর্মী হিসাবে নেওয়া যাবে৷ ফলে অল্প মজুরি, সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকারহীন শ্রমিকের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া গেল৷ এদের সব ধরনের কাজেও লাগিয়ে দেওয়া যাবে৷

আগে শিক্ষানবীশ শ্রমিকদের কাজের সময় ঠিক করতো কেন্দ্রীয় সংস্থা সেন্ট্রাল অ্যাপ্রেনটিশ কাউন্সিল, এখন করবে মালিক নিজেই৷ এমনকি শিক্ষানবিশীর শেষে তাদের স্থায়ী ভাবে নেওয়া, না-নেওয়াও মালিকের ইচ্ছেমাফিক৷ শিক্ষানবীশ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, ইএসআই ও পিএফ পাবার অধিকার, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট ১৯৪৭-এর মাধ্যমে সুরক্ষা পাবার অধিকার থাকবে না৷ অকারিগরী ক্ষেত্রেও শিক্ষানবীশ কর্মী নেওয়া হবে৷ ৫০০টি শিল্পক্ষেত্রে এমনটি করা যাবে৷

কম মজুরি দিয়ে পুরো সময়ের কাজ করানো, কোনও অধিকার না দেওয়া, ইচ্ছে মতো ছাঁটাই করা এমন সব নিয়ে বিশাল সংখ্যায় শিক্ষানবীশ শ্রমিককে খাটানো যাবে৷

chhobi-3
ছবি ৩। খনি শ্রমিক, চিত্তপ্রসাদ, ১৯৫১

আগে এই আইনটি না মানলে মালিকদের শাস্তি হবার কথা ছিল ৬ মাসের জেল৷ এখন শাস্তি সবচেয়ে বেশি হলে মাত্র ১০০০ টাকা জরিমানা৷
নিয়োগের নিয়মাবলী মালিক ঠিক করবে৷ কোনও বাঁধা ধরা নিয়ম থাকবে না৷

যেহেতু একজন শিক্ষানবীশকে চাকরি দেওয়া হচ্ছে, একটা সময় পর্যন্ত এদের মজুরির একটা অংশ সরকার দেবে৷ অর্থাত্ সরকারের টাকায় মালিক মুনাফা করবে৷

এই আইনে শ্রমিকদের বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা যাবে৷ অদক্ষ, আধা দক্ষ, দক্ষ৷ অদক্ষ শ্রমিকের জন্য ঠিক করা মজুরিতে, মালিক ইচ্ছে করলে দক্ষতার যে কোনও স্তরের শ্রমিককে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারবে৷ এখন শিক্ষানবীশ নিয়োগের নামে বিভিন্ন শিল্পে কম পয়সায় অধিকারহীন মজুর/ কর্মচারী খাটনোর আইনী স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া হলো৷

শিক্ষানবীশ শ্রমিক বিষয়টার আর একটা দিক আছে৷ একটা রাজ্যের কারখানায় অন্য রাজ্যের শ্রমিক নেওয়া হতে পারে, হবে৷ এরা হবেন ‘পরিযায়ী’ শ্রমিক (মাইগ্রেন্ট লেবার)৷ তাদের এই রাজ্যে দরকষাকষিতে ক্ষমতা কম হবে৷ যেহেতু তাদের থাকার জায়গা নেই, কোম্পানি মালিক তাদের থাকার জায়গা দেবে, আসলে কারখানার ভিতরে রাতে শোবার জায়গা দেবে৷ এই সুবিধাটুকু দেবার বদলে শ্রমের সময় বাড়িয়ে দেবে ১০ ঘণ্টা থেকে ১২ ঘণ্টা এবং মজুরি দেবে ‘পিস্ রেট’-এ৷

chhobi-4
ছবি ৪। ফাউন্ড্রি শ্রমিক, চিত্তপ্রসাদ, ১৯৫৬

শিক্ষানবীশ শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক এই ধরনের শ্রম নিয়োগ প্রমাণ করে কত জন কাজ পেলেন সেই হিসেবটাই সব নয়, কী ধরনের কাজ পেলেন, সেটাও দেখার৷

৮৷ ইকুয়াল রেমুনারেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৬
বর্তমানের ইকুয়াল রেমুনারেশন অ্যাক্টকে ছোট করে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে৷ বদলে দেওয়া আইনে একটি মাত্র বাক্যে একটি মাত্র বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে৷ একই মালিকের কাজে, একই ধরনের কাজে নিযুক্ত নারী শ্রমিক ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে মজুরির পার্থক্য করা চলবে না৷

ন’টি পাতায় লেখা আগের আইনটিকে এখন একটি বাক্যে পরিবর্তন করা হয়েছে৷ আগের আইনে ছিল, শুধু মজুরির বেলাতেই নয়, নিয়োগের সময়ও কোনও পার্থক্য করা চলবে না পুরুষ ও নারীর মধ্যে৷ নারীরা এই অধিকার হারালেন৷

চালু থাকা আইনে একটা উপদেষ্টা কমিটির কথা ছিল, সেখানে অর্ধেক সদস্য হবেন মহিলা, যারা সরকারকে পরামর্শ দেবেন, কী ভাবে মেয়েদের কাজ পাবার সুযোগ বাড়ানো যায়৷ একজন শ্রম আধিকারিক নিয়োগের কথা ছিল যিনি মহিলাদের অভিযোগ শুনবেন, ব্যবস্থা নেবেন৷ এ সবই বাদ দেওয়া হলো নতুন আইনটিতে৷

৯৷ কনট্রাক্ট লেবার (রেগুলেশন অ্যান্ড অ্যাবোলিশন) অ্যাক্ট, ১৯৭০
এই আইনে ‘ঠিকা শ্রমিক’দের কয়েকটি অধিকারের কথা বলা ছিল৷

বলা ছিল, মূলধারার বড়ো উত্পাদন ক্ষেত্রে ঠিকা শ্রমিক, চুক্তি শ্রমিকদের নিয়োগ করা যাবে না৷ কিন্ত্ত এখন প্রায় সব শিল্পেই সব জায়গাতেই উত্পাদনে ক্রমশ বেশি বেশি করে সস্তা, অসংগঠিত, অরক্ষিত চুক্তি শ্রমিক৷ অতএব এ বার আইনটাকেই বদলে দেওয়া৷

এই আইনটা আগে প্রয়োগ করা যেত না, যেখানে ২০ জনের নিচে কাজ করে৷ এখন করা হলো, যেখানে ৫০ জনের নিচে কাজ করে৷ তার মানে বিপুল সংখ্যক ঠিকা শ্রমিককে আইনের আওতার বাইরে, অধিকার পাওয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো৷ আসলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আইনটিই বাতিল করে দেওয়া হলো৷

chhobi-5
ছবি ৫। ট্রাম লাইন মেরামতি শ্রমিক, চিত্তপ্রসাদ, ১৯৫৮

সরকার চাইছে স্পেশাল ইকনমিক জোন, ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং জোন এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডর এই সব ক্ষেত্রে এই আইনটি ব্যবহার করাই হবে না৷ এখন স্থায়ী চরিত্রের কাজে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করা হবে, যা আগের আইনে বারণ ছিল৷ ঠিকা শ্রমিক (নিয়ন্ত্রণ ও অবলোপ) আইন থেকে ‘অবলোপ’ কথাটাকে তুলে দেওয়া হবে৷ কারণ ঠিকা শ্রমপ্রথার অবলোপ নয়, বরং তাকে বড়ো করে দেওয়া৷

ঠিকা শ্রমিক দিয়ে, অস্থায়ী শ্রমিক দিয়ে, অধিকারহীন শ্রমিক দিয়ে উত্পাদন করানোর জন্য উত্পাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে৷ উত্পাদন প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রিকরণ করা হচ্ছে৷ উত্পাদন কেন্দ্রের আকার ছোট করে ফেলা হচ্ছে৷ মূল কেন্দ্রে শ্রমিক সংখ্যা, স্থায়ী শ্রমিক সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ ভেন্ডার সংস্থা, আউট সোর্সিং বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ ঠিকা শ্রমিক বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ স্থায়ী চরিত্রের কাজে ঠিকা, অস্থায়ী শ্রমিক লাগানো হচ্ছে৷ ঠিকা শ্রমিকের অবলুন্তির বদলে স্থায়ী শ্রমিকের অবলুন্তি ঘটছে৷ ঠিকা শ্রমিক আইন থেকে অবলুন্তি শব্দটা সরিয়ে নেওয়া হলো৷ এবার বদলে নেওয়া আইনে ঠিকা শ্রমিকদের অধিকার কমিয়ে দেওয়া, কেড়ে নেওয়া৷

এখন মূল উত্পাদন কেন্দ্র, মূল কারখানা থেকে কাজ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভেন্ডার কোম্পানিতে, ছোট ওয়ার্কশপে৷ এখানে ঠিকা শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো৷ এরা হলেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে অসংগঠিত শ্রমিক৷ ফলে অধিকারহীন শ্রমিক৷ আবার যদি ঠিকা শ্রমিকরা ঠিকাদারের ঠিকা শ্রমিক হন, তাহলে অনেক সময় এদের নিয়ে কোনও লিখিত তথ্য থাকে না৷ ফলে এরা হলেন পরিচয়হীন, অস্তিত্বহীন শ্রমিক৷ এদের বেলায়  অধিকারের  কথাই  ওঠে  না৷  আবার  মূল উত্পাদন কেন্দ্রে, মূল কারখানায় ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করা হয়৷ এরা হলেন সংগঠিত ক্ষেত্রে অসংগঠিত শ্রমিক৷ এদের দিয়ে স্থায়ী শ্রমিকের মতন কাজ করিয়ে নেওয়া হয়৷ কিন্ত্ত একই রকম কাজে একই রকম মজুরি পাবার অধিকার এদের দেওয়া হয় না৷ এরা স্থায়ী শ্রমিকদের থেকে কম মজুরি পান৷

‘ঠিকা শ্রমিক’ বিষয়টিকে আরও কয়েকটি দিক থেকে দেখা দরকার৷ ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করে ঠিকাদার, শ্রমিক সরবরাহের কোম্পানি এবং ট্রেড ইউনিয়ন৷

এই ব্যবস্থায় মালিকের কয়েকটি লাভ৷ ঠিকাদার দিয়ে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করায় মালিককে শ্রমিক নিয়োগ করার খরচ করতে হলো না৷ ট্রেড ইউনিয়নকে দিয়ে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করায়, ঠিকা শ্রমিকদের ইউনিয়ন না করানো বা মালিকের সমস্যা হতে পারে এমন ইউনিয়ন না করানো নিশ্চিত হলো৷ ঠিকা শ্রমিকের মজুরি ও সুযোগ সুবিধা দেওয়া খাতে খরচ স্থায়ী শ্রমিকের তুলনায় কম৷ স্থায়ী শ্রমিকের জায়গায় ঠিকা শ্রমিক লাগিয়ে শ্রমিক খাতে খরচ কমানো হলো ফলে মুনাফা বাড়ানো গেল৷ কোনও একধরনের কাজে স্থায়ী শ্রমিকের জায়গায় ঠিকা শ্রমিকদের কাজ দিয়ে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা লাগিয়ে দেওয়া হলো৷ স্থায়ী শ্রমিকদের কাজে রাখার শর্ত হিসাবে মজুরি কমিয়ে দেওয়া হলো৷ স্থায়ী শ্রমিককে অস্থায়ী শ্রমিকের মতন বানিয়ে দেওয়া হলো৷

১০৷ ট্রেড ইউনিয়নস্ অ্যাক্ট ১৯২৬
আগের আইনে শ্রমিকদের ১৫ শতাংশ চাইলে ট্রেড ইউনিয়ন বানাতে পারতেন, বদলে নেওয়া আইনে ইউনিয়ন বানাতে গেলে ৩০ শতাংশ শ্রমিককে তা চাইতে হবে৷ তার মানে ২৯ শতাংশ শ্রমিকের ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো৷

কেন্দ্রীয় সরকারের স্তরে আলোচনা চলছে একটা নির্দিষ্ট পরিমান মাইনের ওপরে থাকা কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার থেকে সরিয়ে নেওয়া নিয়ে৷

১১৷ দি স্মল ফ্যাক্টরিজ (রেগুলেশন অফ পেমেন্ট অ্যান্ড কন্ডিশন অফ সার্ভিসেস) বিল ২০১৪
ছোট কারখানার মানে বদলে দেওয়া হলো৷ আগে ২০ জন শ্রমিকের কম হলে ‘ছোট কারখানা’, এখন ৪০ জন শ্রমিকের কম হলে ‘ছোট কারখানা’৷
এই বিলে ছোট কারখানাকে চোদ্দটি শ্রম আইন থেকে ছাড় দিয়ে একটি মাত্র রির্টান জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে৷

বড়ো কারখানাগুলো এখন তাদের কাজ ভাগ করে করে ছোট কারখানায় পাঠিয়ে দিয়ে বানিয়ে নিচ্ছে৷ বড়ো কাজের ছোট ছোট অংশ নিজেরা না বানিয়ে ছোট ছোট কারখানা থেকে নিয়ে নিচ্ছে৷ ছোট কারখানা আইনের নিয়ম থেকে ছাড় পাচ্ছে৷ ছোট কারখানার শ্রমিকরা অধিকার থেকে বাদ যাচ্ছেন৷

সরকারের কৈফিয়ত্/ পুঁজির কথা
বর্তমান সরকারের একটি শ্লোগান ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’৷ ব্যবসা করাকে সহজ করে দেওয়া৷ পুঁজির বিনিয়োগ, উত্পাদন, ব্যবসা, বাণিজ্য, বিদেশি পুঁজির আসা সব ‘সহজ’ করে দেওয়া৷ আর একটি শ্লোগান ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’৷ ভারতে বানানো৷ বিদেশি পুঁজিকে ডাকা ভারতে বানাতে৷ আর এসব করার জন্য শ্রমিক বিষয়ক আইনকে পুঁজির সহায়ক করে তোলা৷ এটা এক ধরনের যুক্তি সাজানো৷

এর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে আর একটা যুক্তি দেখানো যে, এর ফলে বেশি উত্পাদন হবে, বেশি শ্রমিক নিয়োগ হবে, তাতে উন্নয়ন হবে, বা ঘুরিয়ে বলা উন্নয়নের পথে বাধা দূর হবে৷
পুঁজির যুক্তি সরাসরি৷ প্রচলিত শ্রম আইন উন্নয়নের পথে বাধা৷ ফলে উন্নয়নের বাধা সরাতে শ্রম আইন বদল৷

পুঁজির আর একটি যুক্তি এই রকম- পণ্যের চাহিদা বাড়ে কমে, উত্পাদনের বাজার ওঠা নামা করে৷ অতএব এই পণ্য চাহিদা আর উত্পাদন বাজারের ওঠানামার সঙ্গে মিলিয়ে শ্রমিক নিয়োগের ওঠানামার ব্যবস্থা বানাতে হবে, শ্রমিক নেওয়া আর ছাঁটাই করার নিয়মকানুন সাজাতে হবে৷ নিয়োগ আর ছাঁটাইকে বাধাহীন করে দিতে হবে৷ যদিও আমরা জানি যে, বাজার ও চাহিদার জন্য শ্রমিকরা মোটেই দায়ী নন৷

আর এই সাজানোটাকে বলা হচ্ছে ‘জাতীয় স্বার্থ’-এ, আসলে পুঁজিপতিদের স্বার্থে৷ ‘জাতি’ আর ‘পুঁজিপতি’ একই মানে বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷

পুঁজির স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থ দেখিয়ে আরেকভাবে কথা বানানো হচ্ছে৷ পুঁজির বিশ্বায়ন মেনে নিয়ে অবাধ পুঁজি বিনিয়োগের গল্প সাজিয়ে বলা হচ্ছে, পণ্যের বাজার, বিশ্ববাজার এখন স্বাধীন, শিল্প এখন রন্তানি করার জন্য, বাণিজ্য, প্রযুক্তি, পুঁজি এখন অবাধ৷ এমন অবস্থা থেকে সুবিধা পেতে হলে পুঁজির সঙ্গে শ্রমের দ্বন্দ্ব থাকলে চলবে না৷ ফলে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নেওয়ায় শ্রমিকদের স্বার্থ ছেড়ে দিতে হবে, তাদের অধিকার থেকে সরে আসতে হবে৷ কারণ শ্রমিক স্বার্থ ‘জাতীয় স্বার্থ’ নয়৷ পুঁজির স্বার্থ মেনে নিতে হবে, কারণ পুঁজির স্বার্থই জাতীয় স্বার্থ৷ আর তার জন্যই এমন ভাবে আইন বদল৷

আর একটা কথা বুঝে নেওয়া৷এখন উত্পাদনে রাষ্ট্র আর নেই৷ উত্পাদনের জায়গা রাষ্ট্র বেসরকারি পুঁজিকে, সংস্থা পুঁজিকে ছেড়ে দিচ্ছে৷ উত্পাদনে এখন তারাই একচেটিয়া৷ অতএব তাদের কথা ভেবেই, মেনেই শ্রম আইন বানানো, শ্রম ব্যবস্থা সাজানো৷

রাষ্ট্র আর একটা যুক্তি শোনাচ্ছে৷ রাষ্ট্র নাকি চায় অনেকে কাজ পাক৷ অনেককে কাজ দিতে গেলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে৷ বিনিয়োগের সুবিধা অনুযায়ী নতুন শ্রম আইন দরকার৷ অথচ এই শ্রম আইন শ্রমিক বিরোধী, কর্মসংস্থান বিরোধী৷ যুক্তির শুরুর সঙ্গে শেষের বিরোধ৷

অন্যভাবেও এই যুক্তিটাকে দেখা যেতে পারে৷ কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে পুঁজি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে৷ পুঁজি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে পুঁজিকে মুনাফা বাড়াতে দিতে হবে৷ মুনাফা বাড়াতে দিতে হলে শ্রম খাতে ব্যয় কমাতে দিতে হবে৷ শ্রম খাতে ব্যয় কমানো যায় কর্মসংস্থান কমিয়ে দিয়ে৷ যুক্তিধারার মধ্যেই দ্বন্দ্ব৷আর এভাবেই এই আগের শ্রম আইনগুলো এখন পাল্টানো৷ নতুন শ্রম আইন এখন বানানো৷

আর এক ভাবে, তথ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও পুঁজির যুক্তিটাকে ধরতে চাইছি৷

ধরা যাক পোশাক শিল্পের কথা৷ সেখানকার তথ্য এই রকম- ৯২ শতাংশ কারখানায় ৮ জনের কম শ্রমিক কাজ করেন৷ সেখানে শ্রমিক নিয়োগ বাড়াতে তো চালু শ্রম আইনে কোনও বাধা ছিল না৷ বরং অন্য অন্য বাধার কথা রয়েছে৷ বলা হয়েছে কম বিনিয়োগ, নেমে থাকা বাজার/ চাহিদা, বিদ্যুত্ ও রাস্তার সমস্যা, প্রশাসনের গাফিলতি এই রকম সব বাধা৷

ধরা যাক আর একটি রটনা৷ যে সমস্ত রাজ্যে শ্রম আইন যথাযথ প্রয়োগ করা হয়েছে, সেখানে উত্পাদন কম বেড়েছে৷ বলা হয়নি শ্রমআইনের বিষয়টিই একমাত্র বা প্রধান বাধা কি না৷ বরং এমন কোন তথ্য নেই যা দিয়ে বলা যায় শ্রম আইনের কড়াকড়িই অন্য সব বাধার ওপর জায়গা নিয়েছে৷ অন্য সব সমস্যার ওপরে শ্রম আইন, এমন কোনও প্রমাণ দাখিল করা হয়নি৷ উল্টে আমরাই বলতে পারি বেশির ভাগ শিল্পে তো কম শ্রমিক রাখা হয়েছে৷ উত্পাদন বাড়ানোর জন্য শ্রমিক সংখ্যা বাড়ানো হয়নি কেন? কোন শ্রম আইন তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে?

chhobi-6
ছবি ৬। শিশু বিড়ি শ্রমিক, চিত্তপ্রসাদ, ১৯৫১

এখনকার এই একধারসে শ্রমিক আইন বদলের আগে নানা রাজ্যে নানা সময়ে নানা অজুহাতে শ্রমিক আইনে বদল আনা হয়েছে৷ রাজ্য সরকারগুলি তাদের রাজ্যে, বিনিয়োগ আনার প্রতিযোগিতায় প্রধান বিষয় করেছে শ্রম আইন বদল, পুঁজির পক্ষে বদল৷

উত্তরপ্রদেশে ১৯৮৩-তে, গুজরাটে ২০০৪-এ, অন্ধ্রপ্রদেশে ২০০৬-এ বিভিন্ন বিষয়ে ছাড় পাওয়ার জন্য,  শ্রমিকদের নানা  সুযোগ সুবিধা দেওয়া থেকে,  বা শ্রমিকদের পক্ষে যায় এমন সব বিষয়ে ছাড় পাওয়ার জন্য মালিকদের আবদারে আইন পাল্টানো হয়েছে৷ কই এর ফলে যে শ্রমিক সংখ্যা বেড়েছে এমন তথ্য জানা যায় না৷ নানা আইন বদলিয়ে মালিকদের পাইয়ে দেবার যে ‘গুজরাট মডেল’, সেখানে শ্রম নিয়োগ বেড়েছে এমন তথ্য তো জানানো হয়নি৷

অন্য আর এক ভাবে দেখা যাক৷ গত দু’দশকে পরিষেবা ক্ষেত্রে এত কম শ্রম নিয়োগ কেন? সেখানে তো নির্মাণ ক্ষেত্র বাদে অন্য কোথাও শ্রম আইনের প্রয়োগ নেই৷ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট তো শিল্প ক্ষেত্রের জন্য৷ পরিষেবা ক্ষেত্রের জন্য নয়৷ তাহলে কোন আইন তাদেরকে শ্রম নিয়োগে বাধা দিয়েছে? বরং উল্টো দিক থেকে বলা যায়, যদি শ্রম আইন খুব শক্তপোক্ত হবে, তাহলে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০০৮ সালে শ্রম প্রধান রন্তানিমুখী শিল্প ক্ষেত্রে কি করে ১০ লক্ষ শ্রমিককে ছাঁটাই করা হলো?

এর পাশাপাশি অন্য একটা দিক থেকে, হাতের কাছে থাকা একটা তথ্য দিয়ে একটা কথা বলা যাবে৷ ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভের তথ্য বলছে ২০১১-১২ সালে, সংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশের কোনও লিখিত কর্মচুক্তি নেই, অথবা এক বছরের কম সময়ের কর্মচুক্তি আছে৷ তাহলে আইনের কড়াকড়ি কোথায়? আসলে ইচ্ছেটা হলো, যেভাবে হোক, যতটা পারা যায়, শ্রমিকদের আয় কমিয়ে দেওয়া, কাজের অবস্থাকে খারাপ করে তোলা৷ আর এর সাথেই সরাসরি যুক্ত পুঁজির আয়, মালিকের মুনাফা৷ প্রথমটাকে যতটা খারাপ করা যাবে, দ্বিতীয়টা ততটা ভালো হবে৷ এই ব্যবস্থা করাটার নাম শ্রমআইন সংস্কার বা শ্রম সংস্কার৷ সংস্কার মানে সরাসরি আক্রমণ৷ শ্রমকে পুঁজির, রাষ্ট্রের আক্রমণ৷ যে ভাবে খুশি শ্রমিক নেওয়া, যেমন ইচ্ছে শ্রমিক খাটানো, যখন খুশি শ্রমিক ছাঁটাই৷

এমন সব যুক্তি, কথা শোনাচ্ছে দেশের, বিদেশের শিল্প, বাণিজ্য মালিকরা, বড়ো সংবাদপত্ররা, একদল অর্থনীতিবিদ৷ অর্থনীতির পরিবর্তনে এদের কথা আমাদের দিয়ে মানিয়ে নেওয়ানো, অর্থনীতির সঙ্গে মিলিয়ে শ্রম আইন বদল আমাদের দিয়ে মানিয়ে নেওয়ানো৷

এখন চলা শ্রম আইনের ভিতরেই গোলমাল
শ্রম আইন বদলানো নিয়ে আলোচনাটা এমন ভাবে চলছে যেন এই সব আইনের সব ধারাগুলিই শ্রমিকদের পক্ষে এবং মালিকদের বিপক্ষে ছিল৷ আইনগুলি এমন যেন মালিকরা তা না মানলে তাদের শাস্তি হবে৷ মোটেও তা নয়৷

chhobi-7
ছবি ৭। শ্রমিক আন্দোলন, চিত্তপ্রসাদ

কয়েকটি উদাহরণ৷
উদাহরণ, ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্ট ১৯৪৮৷ এই আইনে শ্রমিকদের কয়েকটি বিষয়ে কিছু অধিকারের কথা বলা আছে৷ আর মালিকরা আইন না মানলে তাদের জরিমানা ও জেলের ব্যবস্থা রয়েছে৷ আবার একই আইনে এমন কথাটি রয়েছে যে, এই আইন ভাঙলে রাষ্ট্রের শ্রমদন্তরের অনুমোদন ছাড়া মালিকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না৷ শ্রমিক ও মালিকের মুখোমুখি সম্পর্কের মাঝখানে প্রশাসন এসে দাঁড়ালো৷ এই প্রশাসন অবশ্যই মালিকদের পক্ষে৷ ফলে আইন না মানলে মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না৷

উদাহরণ, ন্যূনতম মজুরি আইন৷ মালিক এই আইন ভাঙলে তিন মাসের ভিতর শ্রম দন্তরের অনুমোদন ছাড়া মালিকের বিরুদ্ধে আদালতে যাবার কাজকর্ম শুরু করা যাবে না৷

উদাহরণ, ঠিকা শ্রমিক (নিয়ন্ত্রণ ও অবলুন্তি) আইন৷ এই আইনের মধ্যে দিয়ে স্থায়ী ধরনের কাজে ঠিকা শ্রমিক প্রথা ‘অবলোপ’ মানে বন্ধ করা হবে কি না সেটা শ্রমদন্তরের মর্জির ওপর নির্ভরশীল৷ এই আইনে আছে, না মানলে মালিকের জরিমানা ও জেল৷ আবার এই আইনেই আছে শ্রম দন্তরের সুপারিশ ছাড়া মালিকের বিরুদ্ধে কোনও মামলা করা যাবে না৷ আর একটি ধারায় আছে, মালিকের বেআইনী কাজের বিরুদ্ধে তিন মাসের মধ্যে শ্রমদন্তর আদালতে না গেলে আর কোনও মামলাই করা যাবে না৷

উদাহরণ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট ১৯৪৭৷ যে কোনও একজন বা অল্প কিছু শ্রমিক যৌথ ভাবে মালিকের বিরুদ্ধে শ্রমবিরোধ বিষয়ে কোনও অভিযোগ শ্রম দন্তরে দায়ের করতে পারবে না, যদি না ট্রেড ইউনিয়ন তাদের পাশে দাঁড়ায়৷

উদাহরণ দেখানো থেকে পাওয়া সার কথা৷ ছাঁটাই বা সেই বিষয়ে মামলা ছাড়া অন্য অন্য শিল্পবিরোধের ক্ষেত্রে শ্রমিকের এমনকী ট্রেড ইউনিয়নেরও সরাসরি মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তাকে কৈফিয়ত্ দিতে বাধ্য করার মতো আইনী অধিকার কোনও দিনও ছিল না৷

অথচ ভারতে দেওয়ানি, ফৌজদারি আইনে, যে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে, যে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা সরাসরি আদালতের কাছে গিয়ে অপর পক্ষকে তার কাজের জন্য কৈফিয়ত্ দিতে বাধ্য করতে পারে৷

তাহলে কি একদিকে, শ্রমিকরা আইনের বাইরে একভাবে, তারা আইনী ব্যবস্থা নিতে পারবেন না৷ অন্য দিকে, মালিকরা আইনের বাইরে আরেকভাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না৷

এ তো গেল আইনী ব্যবস্থা না পাওয়ার কথা৷ এবার দেখা যাক, প্রশাসনিক ব্যবস্থার কথা৷
শিল্প বিরোধ আইন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট ১৯৪৭-এর ধারা অনুযায়ী- এক, শিল্প বিরোধ দায়ের হবার পর মালিককে আলোচনায় টেনে আনতে বাধ্য করার কোনও ক্ষমতা শ্রম দন্তর বা শ্রমিকের হাতে নেই৷ দুই, আলোচনার মাধ্যমে একটি শিল্পবিরোধের মীমাংসা না হলে, সেই শিল্প বিষয়টিকে বিচারের জন্য শ্রম আদালত বা শিল্প ট্রাইবুনালে পাঠানো হবে কি না সেটা শ্রমদন্তরের মর্জির ওপর নির্ভরশীল৷ তিন, শিল্প ট্রাইবুনাল বা শ্রম আদালতের রায় যতক্ষণ না পর্যন্ত সরকার প্রকাশ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেটি রূপায়ন করা যাবে না৷ চার, শ্রম ট্রাইবুনালের আদেশ অমান্য করলে কোনও মালিকের জেল ও জরিমানার বিধান থাকলেও শ্রম দন্তর ছাড়া অন্য কেউ মালিকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে পারবে না৷

এত সব কথার পরে এমন একটা মতে আমরা সহজেই পৌঁছতে পারি যে, শ্রমিক আর মালিকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে শ্রম দন্তর, সরকার, রাষ্ট্র৷ আর মাঝখানে যারা দাঁড়িয়ে, তারা পক্ষপাতী৷ মালিকের পক্ষে, শ্রমিকের বিপক্ষে৷ লেঅফ, ক্লোজার, ছাঁটাই সংক্রান্ত বিষয়ে শুধুমাত্র নীরব থেকেই শ্রমদন্তর মালিককে অনুমোদন দিয়ে দিতে পারে৷
শ্রম আইন ব্যাখ্যা করা, প্রয়োগ করা হয়, মালিকের স্বার্থে, শ্রমিকের স্বার্থে নয়৷ একটু এগিয়ে বলাই যায় শ্রম আইনের মূল কাঠামোটাই শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী৷

এখন থাকা শ্রম আইনই যে পক্ষপাতী, মালিকদের পক্ষে, শ্রমিকদের বিপক্ষে এই কথাটি আর এক ভাবে বুঝে নেওয়া যায়৷ উদাহরণ দিয়ে বলার আগে এক কথায় বিষয়টা সেরে নিই৷
যে যে আইন বদলানো হচ্ছে, যে ভাবে বদলানো হচ্ছে, তার একটা বিষয় হলো আগে সে আইনটি, আইনে থাকা বিষয়গুলি একটা সংখ্যক শ্রমিক পর্যন্ত কাজে লাগানো যেত, এখন আরও বেশি সংখ্যক শ্রমিকের বেলায় তা কাজে লাগাতে পারবে মালিকরা৷

কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক৷
১৷ ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্ট ১৯৪৮৷ এই আইনের বলে শ্রমিকদের যা যা পাওনা তা পাবেন সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকরা৷ কোন সংস্থাকে সংগঠিত শিল্প বলা হয়েছে? যে সংস্থায় বিদ্যুতের ব্যবহার না থাকলে ২০ জন শ্রমিক, আর বিদ্যুতের ব্যবহার থাকলে ১০জন শ্রমিক আছেন৷ তার মানে যে কারখানায় বিদ্যুতের ব্যবহার ছাড়া ১৯ জন, আর বিদ্যুতের ব্যবহার নিয়ে ৯ জন শ্রমিক আছেন তারা এই আইন অনুযায়ী কোনও অধিকার পেতে পারেন না, কেন? তারা কি শ্রমিক নন? তারা কি উত্পাদনে শ্রম দিচ্ছেন না? তাহলে তারা শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার পাবেন না কেন?

২৷ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট ১৯৪৭৷ এই আইনটি কারখানা থেকে শ্রমিকদের ছাঁটাই করার জন্য মালিকদের সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার বিষয়ে৷ প্রস্তাবিত আইন পরিবর্তনের আগে, এখনকার আইনে যদি শ্রমিক সংখ্যা ১০০ হয় তাহলে অনুমতি নিতে হতো না৷ কেন? ১০০ জন শ্রমিক কি শ্রমিক নন? তারা কি উত্পাদনে শ্রম দেন না? তাহলে মালিকদের ইচ্ছে অনুযায়ী তাদের যখন তখন ছাঁটাই করা যাবে কেন? কারখানা বন্ধ করে দেওয়া যাবে কেন?
ঠিক এমনি কনট্রাক্ট লেবার (রেগুলেশন অ্যান্ড অ্যাবোলিশন অ্যাক্ট)-এর আওতায় ছিলেন না সেই সব সংস্থার শ্রমিকরা যেখানে ২০ জনের নিচের সংখ্যার শ্রমিকরা কাজ করেন৷
এই বিষয়ে সবচেয়ে ভয়ংকর ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট ১৯২৬৷ এই আইনে বলা ছিল শ্রমিকদের ১৫ শতাংশ চাইলে তবেই ইউনিয়ন বানাতে পারতেন, না হলে নয়৷ কেন? ১৪ শতাংশ শ্রমিকরা কি শ্রমিক নন? তাদের কি দাবি দাওয়া থাকতে হয় না? এ আবার কী কথা?

chhobi-8
ছবি ৮। হরতাল, চিত্তপ্রসাদ, ১৯৫১

এই ভাবে শ্রমিক সংখ্যা দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার পাওয়া, না-পাওয়া, এর যুক্তি,  রাষ্ট্রের পক্ষে, পুঁজির পক্ষে যুক্তি, ট্রেড ইউনিয়নরা, সমস্ত ট্রেড ইউনিয়নরা কেন মেনেছেন, মেনে চলেছেন? কী কারণে? উত্তর জানা নেই৷

ট্রেড ইউনিয়ন চুপ করে থাকলে, থেমে থাকলে পুঁজি এবং রাষ্ট্র থেমে থাকে না, চুপ করে থাকে না৷ এখন সরকার এবং পুঁজি অধিকার না-পাওয়া, না-দেওয়া শ্রমিকদের সংখ্যাটা বাড়িয়ে দিল৷ শ্রমিকদের অধিকার কমিয়ে দিয়ে, বাতিল করে দিয়ে, মালিকদের অধিকার, পুঁজির অধিকার বানিয়ে দিল, বাড়িয়ে দিল৷

শ্রমিকদের কী করা
শ্রমিকদের দু’টি সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা ছিল৷ এক, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রিয় আইন৷ দুই, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন৷ নতুন প্রস্তাবিত শ্রম আইনে এই দুটি সুরক্ষা ব্যবস্থার যতটুকু শ্রমিকদের পক্ষে ছিল, থাকার কথা, সেটুকু থেকেও শ্রমিকদের সরিয়ে দেওয়া হলো৷

বর্তমানে চালু থাকা আইনগুলি নিয়ে আলোচনার সময় দেখা গেল রাষ্ট্র এবং ট্রেড ইউনিয়ন কেউই শ্রমিকদের ঠিকঠাক পাশে নেই৷
শ্রমিক নীতি বানানোয়, নীতি বানানোর কাজে শ্রমিকদের রাখা হয়নি৷ শ্রমিকরা প্রশাসনে নেই, সংগঠনে নেই, শ্রম বিষয়ক আলোচনায় নেই৷ তাদের বাদ দিয়েই তাদের নিয়ে নীতি, আইন বানানো৷

জোরদার শ্রমিক আন্দোলন কম, শ্রমিকরা খবরে নেই, মধ্যবিত্ত ভাবনায়, সহযোগিতায় নেই৷ শ্রমিক আর সমাজের মধ্যে যোগাযোগ কমে যাচ্ছে৷ ট্রেড ইউনিয়নরা বড়ো দলেদের ট্রেড ইউনিয়ন৷ অথচ বড়ো দলেদের রাজনীতির ছকে ট্রেড ইউনিয়নের বিষয় নেই, শ্রমিকরা নেই৷ শ্রমিক আন্দোলন ও রাজনীতিক আন্দোলনের মধ্যে যোগাযোগ নেই, রাখা হয়নি৷
তাই যদি হয়, তা হলে প্রশ্ন উঠবে, রাষ্ট্র এবং পুঁজি কেন নতুন আইন বানাবে, যদি পুরনো আইনে তার কোনও অসুবিধা না হয়ে থাকে?

একটা সম্ভাব্য উত্তর হলো প্রতিষ্ঠিত, প্রচলিত, জানা ধরনের বড়ো ট্রেড ইউনিয়ন ও তাদের আন্দোলনের বাইরে নতুন ধরনের শ্রমিক আন্দোলন তৈরি হয়েছে, হচ্ছে৷ যা প্রধানত নতুন বর্গের শ্রমিকদের আন্দোলন৷ নতুন শিল্প এলাকায়, নতুন ধরনের আন্দোলন৷ সেই আন্দোলন আটকে দেওয়া, আরও অন্য অন্য কারণের মতো নতুন শ্রমিক আইন বানানোর একটা বড়ো কারণ৷

এটুকু শ্রমিকরা বোঝেন যে, শ্রম আইনের জন্ম এবং তাকে টিকিয়ে রাখা, শ্রমিকদের অধিকার পাওয়া, তা যতটুকুই হোক, নির্ভর করে শাসক শ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং সংগ্রামের ওপর৷ শ্রম আইনে যা যা এবং যতটা পাওয়া গেছে তা শ্রম আন্দোলনের জোরেই৷

যদিও সংগঠিত কর্মক্ষেত্রের চুক্তিবদ্ধ ও অস্থায়ী শ্রমিকরা নিজেদের শক্তিতে ততটা সংগঠিত নন, তবুও অনেক জায়গায়, কারখানা স্তরে, এলাকা স্তরে জড়ো হবার উদাহরণ দেখা যাচ্ছে, তা প্রতিষ্ঠিত, প্রচলিত, আইনী ট্রেড ইউনিয়ন কাঠামোর বাইরে৷ সংহতি সমাবেশ দেখা যাচ্ছে, একটি কারখানার পাশে আর একটি কারখানা, একটি অঞ্চলে একটি কারখানার পাশে অঞ্চলের বাকি কারখানা৷ স্থায়ী, অস্থায়ী, চুক্তিবদ্ধ, শিক্ষানবীশ শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য৷ এক নতুন ধরনের শ্রমিক আন্দোলন৷ কখনো কখনো তা প্রচলিত শ্রমিক আন্দোলনের ধরনের বাইরে চলে গেছে, যাচ্ছে৷

chhobi-9
ছবি ৯। হরতাল, চিত্তপ্রসাদ, ১৯৬১

যখনই আইনী ট্রেড ইউনিয়নের পরিসরে অধিকার হারানো, অধিকার না-পাওয়া, তখনই শ্রমিক শ্রেণী খুঁজে বের করে, বানায় লড়াইয়ের নতুন ধরন, যা প্রচলিত, সমঝোতাকারী রাজনীতিবিহীন ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে৷ প্রতিদিনের জীবন যাপনের সংগ্রামের সঙ্গে মিলিয়ে শ্রমিক আন্দোলন৷ এইটুকু বোঝা গেছে যে শ্রমিক আন্দোলন করেই শ্রমিক অধিকার পাওয়া৷ ট্রেড ইউনিয়নদের শ্রমিকদের দিয়ে আন্দোলন না করানোতেই শ্রমিক অধিকার হারানো৷

একদল চুপ করে বসে থাকলে আরেকদল চুপ করে বসে থাকবে, তা ঠিক নয়৷ প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়নগুলি আন্দোলন করেনি তাই পুঁজি আক্রমণ করেছে৷

বর্তমানে চালু শ্রম আইনগুলি নিয়েই আন্দোলন করার দরকার ছিল, করা হয়নি৷ বহু আইন আছে যা অসম্পূর্ণ৷ বহু আইন আছে যা শ্রমিকদের পক্ষে প্রয়োগ করা হয় না৷ বহু আইন আছে যার নানা অংশই শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী৷ এসব নিয়ে আন্দোলন হয়নি৷ বড়ো ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন করেনি৷ ট্রেড ইউনিয়ন চুপ করে থেকেছে বলে মালিক চুপ করে থাকবে, তা নয়৷ পুঁজি আক্রমণ বানিয়েছে৷ শ্রমিকদের যতটুকু আইনী অধিকার ছিল, সেটাও কেড়ে নেওয়া হলো৷

শ্রমিক আইনের সাথে, শ্রমিক অধিকার পাওয়া আইনের সাথে শ্রমিকদের কখনও যোগাযোগ গড়ে দেওয়া হয়নি৷ সরকার করেনি, করবে না৷ ট্রেড ইউনিয়ন করেনি, করবে না৷ শ্রমিকরা বুঝলে যদি ট্রেড ইউনিয়নের, ট্রেড ইউনিয়ন বানানো রাজনীতিক দলদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়৷ শ্রমিকরা নিজেরাও যোগাযোগ গড়ে তোলেননি৷ তারা ভেবেছেন, তাদের ভাবানো হয়েছে, ওটা শ্রমিক নেতা আর আইনজীবীদের বিষয়৷

ভারতের সংবিধানে নানা ধারা, উপধারায় শ্রমিকদের পক্ষে থাকা কথা রয়েছে৷ রাষ্ট্রকে সম্পদ ও মালিকানার সুষম বণ্টন, সকলের জন্য সমান বিচার, ভালো বেতন, কাজের মানবিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সর্ব উচ্চ উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ অথচ বেশ কিছু শ্রম আইনকে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে সংবিধানের কথার বিরোধিতা রয়েছে৷

বড়ো ট্রেড ইউনিয়নরা এসব নিয়ে ভাবেনি, ভাবতে চায়নি৷ বড়ো ট্রেডইউনিয়ন যে সব রাজনীতিক দলেদের, তারা হয় সরকারে আছে, সরকারে থাকতে চায়, কিংবা সরকারে ছিল এবং আবার আসতে চায়৷ এবং সব সরকারের সঙ্গে পুঁজির ভাব৷ অতএব শ্রমিকদের সঙ্গে ভাব নয়৷ বিরোধিতা৷

সরকারের বাইরে বাকি থাকে আদালত৷ সেখানে শ্রমিকদের যাওয়া বারণ৷ সেখানে কোনও কিছুই শ্রমিকদের পক্ষে নয়৷ কোনও পুঁজি মালিকের কোনও সাজা হয় না৷

কোনও রাজনীতিক দলের সদস্যরা লোকসভা কিংবা রাজ্যসভায় শ্রমিকদের হয়ে কথা বলে কিছু আদায় করে না৷ বাকি রইল শ্রমিকরা নিজেরা৷ নিজেদের জন্য নিজেরা৷ আর এখানেই পুঁজির সবচেয়ে বড়ো ভয়৷

এখন সত্যি সত্যি শ্রমিকদের হারাবার কিছু নেই৷ তথাকথিত সমাজকল্যাণমুখী রাষ্ট্র এখন শ্রম আইন সংশোধনের মধ্যে দিয়ে যতটুকু অন্তত কাগজে কলমে শ্রমিকদের পাশে ছিল, সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল, সেটুকুও সরিয়ে নিল৷

ট্রেড ইউনিয়ন এতদিন চালু থাকা আইনগুলো নিয়ে, আইনগুলোর ভিতরে যা যা শ্রমিক বিরোধী, তা নিয়ে বড়ো জোরদার আন্দোলন করেনি, আন্দোলন করে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেনি৷

বামপন্থী দলগুলি, যাদের নেতৃত্বে থাকার কথা শ্রমিক শ্রেণীর, তাদের নেতৃত্ব থেকে, আদর্শ থেকে, কর্মসূচি থেকে, শ্রমিকদেরকে, শ্রমিকআন্দোলনকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ তাদের এখন কর্মসূচি কি ভাবে ভোটে জিতে সরকারে যাওয়া যায়৷ এবং সরকারে গিয়ে পুঁজির সঙ্গে থাকা যায়৷                         

chhobi-10
ছবি ১০। শ্রমিক সংহতি, চিত্তপ্রসাদ, ১৯৪৫

শ্রমিকদের পাশে মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীরা নেই৷ মধ্যবিত্ত এখন বদলে গেছে, যাচ্ছে৷ বদলে যাওয়া মধ্যবিত্ত এখন পুঁজির সঙ্গে৷ তার অনেক কিছু পাওয়ার ইচ্ছে, যা তার ভাবনায় পুঁজির সঙ্গে থাকলে পাওয়া যাবে৷

ফলে, সত্যি সত্যি শ্রমিক শ্রেণী এখন সরাসরি পুঁজির মুখোমুখি৷ পাশে এবং মাঝখানে আর কেউ নেই৷

অথবা আছে৷ এখন রাষ্ট্র আর পুঁজির সরাসরি আক্রমণের মুখে শুধু শ্রমিকরা নয়, আরও অনেকে৷ ভূমিবাসী, কৃষিজীবী, আদিবাসী, বনবাসী, সমুদ্রতীর বাসী, মত্স্যজীবী, নদীতীরবাসী, শহর দরিদ্র, দরিদ্রবসতিবাসী, ছোট কারিগর, ছোট ব্যবসাকারী, হকার, জাত ব্যবস্থার একদম নিচে যারা এমন আরও অনেকে৷ যাদের কোনও অধিকার নেই৷ যাদের অধিকার একটা একটা করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে৷ এদের সবার মোর্চা, সংঘবদ্ধতা, নানা জায়গায়, নানা ভাবে, নানা কারণে৷

বাইরে পা ফেলা, হাত বাড়াবার আগে, শ্রমিকদের নিজেদের জায়গাটা গুছিয়ে নিতে হবে৷ শ্রমিকরা এখন, এক অর্থে ‘স্বাধীন’৷ একটা বড়ো সংখ্যক শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন বানাবার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ ফলে তাদের সমাবেশ এবং আন্দোলন ট্রেড ইউনিয়ন মুক্ত৷ তারা আর ট্রেড ইউনিয়নের ‘পরাধীন’ নয়৷ যেহেতু তাদের সরকার স্বীকৃত, সরকার নিয়ন্ত্রিত ট্রেড ইউনিয়ন নেই, তারা আর তাদের সমাবেশ ও আন্দোলন পরিসরে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত নয়৷

নতুন আইনের ধারায় পুঁজি, কারখানা মালিক এখন, রাষ্ট্রিয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে৷ নতুন আইনের ধারাতেই শ্রমিকও এক অর্থে রাষ্ট্রিয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে, রাষ্ট্রিয় আইনের, শ্রমিক আইনের বাইরে৷ সেই দিক থেকে শ্রমিক এক ধরনের ‘স্বাধীন’৷

এখন এই স্বাধীনতাকে কাজে লাগানো৷ নতুন ধরনের, নতুন ভাবনার শ্রমিক আন্দোলন৷

এখন শ্রমিকদের নিজেদের বুঝে নেওয়া, তাদের কাজ বা শ্রম এবং মজুরি বাজারের অন্যান্য পণ্য আর দামের মতন নয়, যা এখন বোঝানো হচ্ছে, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রমিকদের সামাজিক অবস্থান, রাজনীতিক দায়িত্ব, ঐতিহাসিক ক্ষমতা৷

আমি শ্রমিক নই, শ্রমিক সংগঠনে নেই, শ্রমিক অঞ্চলে থাকি না, ফলে শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে আমার বলার অধিকার নেই৷

যৌবনে শ্রমিক আন্দোলনে থাকা, শ্রমিক অঞ্চলে নানা কাজে ঘোরাঘুরি করা, এখন এই বয়স্ক সময়ে বন্ধ কারখানা এলাকায় ঘুরে বেড়িয়ে, শ্রমিকদের সাথে কথা বলে, শ্রমিকদের কাছ থেকে শুনে যে ক’টি বিষয় মাথায় এসেছে বলে ফেলি৷

এখন নতুন ধরনের শ্রমিক আন্দোলনের সময়৷ শ্রমিক আন্দোলনে চালু থাকা, না-চালু থাকা নানা উপাদান নিয়ে আসা৷

আন্দোলন যেমন একটা কারখানা ধরে, তেমনি একটা শ্রমিক এলাকা ধরেও৷ শ্রমিকদের বিষয়ের সাথে এলাকার অন্য অন্য গরীবদের বিষয় মিলিয়ে দেওয়া৷

যেমন এলাকার একটা কারখানা ধরে, তেমনি দুটো, তিনটে কারখানা ধরে৷ যারা এক জায়গায় থাকেন, পাশের জায়গায় থাকেন, তারা মিলেমিশে৷

শ্রমিক আন্দোলনে শুধু এখনকার চালু কারখানায় কাজে থাকা শ্রমিক নন, এখনকার বন্ধ করে রাখা কারখানার শ্রমিকরা, এখন বন্ধ করে রাখা কারখানায় শ্রমিক ছিলেন এবং এখন অন্য অন্য কাজে আছেন, তারা৷

একটা নতুন শ্রমিক ধারণার উদাহরণ দেওয়া যায়৷ ‘আন্দোলনকারী শ্রমিক’৷ তারা আগে শ্রমিক ছিলেন, এখন অন্য অন্য কাজে৷ তারা ‘আন্দোলনকারী শ্রমিক’৷ সকালে আয়ের জন্য কাজে যাওয়া, সন্ধেয় ‘আন্দোলনকারী শ্রমিক’ হিসাবে কাজ করা৷ অথবা রাত্রে আয়ের জন্য কাজে যাওয়া, সকালে দুপুরে আন্দোলনের কাজে থাকা৷

কোনও একটা কারখানায় এখন কাজ না করলেও পুরনো বসতিতে থেকে যাওয়া৷ শ্রমিক বসতিকে আন্দোলনের বসতি হিসাবে দেখা৷ জড়ো হওয়া, কথা বলা, আলোচনা করা, তর্ক করা৷ মতামত বানানো৷ বসতির ঘরে ইস্কুল চালানো, সকালে ছোটদের, সন্ধেয় বড়োদের ‘শ্রমিক অধিকার পাঠশালা’৷ শ্রমিকদের নিজেদের দরকারি বিষয় নিয়ে, অর্থনীতি, রাজনীতি বিষয় নিয়ে লেখাপড়া, জানা বোঝার জন্য৷ বসতির ঘরে ছোটখাট অসুখ দেখানো, সারানোর ব্যবস্থা রাখা৷ ছোট একটা ‘শ্রমিক ব্যাঙ্ক’ বানানো৷ চালু কারখানার শ্রমিকরা তুলনায় বেশি জমা দেবেন, বন্ধ করে রাখা কারখানার শ্রমিকরা কম জমা রাখবেন৷ শুরু করা যেতে পারে দিনে এক টাকা জমা রেখে৷ কারও খুব দরকারে ধার দেওয়া৷

নিজেদের ছোটখাটো দরকারি জিনিস নিজেদের দক্ষতায়, উদ্যোগে বানানো, কাজে লাগানো৷ শ্রমিক সমবায়৷ শ্রমিকদের বানানো, শ্রমিকদের বিলি করা, শ্রমিকদের ব্যবহার করা৷ একটা ‘শ্রমিক অর্থনীতি’ বানানো৷ এখন তো আর দেশজুড়ে একটা অর্থনীতি নেই৷ অনেক ভাগের অর্থনীতি৷ ধনী অর্থনীতি, মধ্যবিত্ত অর্থনীতি, দরিদ্র অর্থনীতি৷ আপাতত এই দরিদ্র অর্থনীতির মধ্যেই শ্রমিক অর্থনীতি৷ নিজেদের ওপর নির্ভর করে নিজেদের জীবনযাপন৷

শ্রমিক সমবায়ে বন্ধ করে রাখা কারখানা খোলা৷ কারখানা বন্ধ করে দেবার আগে কারখানাটিতে যা উত্পাদন হতো, তা বানানো যায়, অন্য কিছুও বানানো যায়৷

যদি বন্ধ করে রাখা কারখানা না খোলা হয়, শ্রমিক সমবায়ে খুলতে দেওয়া না হয়, তাহলে বন্ধ করে রাখা কারখানা, কারখানার ঘরবাড়ি, মেশিন, মালপত্তর জমিজমায় পুঁজির দখলদারি আটকানো৷ এসবের উপর শ্রমিক অধিকার বানানো, দাবি করা৷ পুঁজির দখলদারির বিপরীতে শ্রমিকদের দখল অধিকার বানানো৷ সেই জমিতে শ্রমিকদের ছোট কারখানা, বাসা, ইস্কুল, চিকিত্সালয়, খেলার মাঠ, মিটিংয়ের মাঠ, আড্ডার জায়গা বানানো৷ কারখানা শ্রমিকরা নিজেরা ছেড়ে চলে আসেননি৷ মালিকদের কাছে তাদের পাওনা পাননি৷

কারখানার জমি মালিকরা যা বেশির ভাগ সময় তাদের জমি নয়, বেচে দিচ্ছে৷ কারখানা সরকারের জমি, কারখানা না চালালে তা সরকারের কাছে ফিরে আসার কথা৷ সরকারের জমিতে, এই জমিতে কাজ করা, তা কোনও ভাবে ব্যবহার করা শ্রমিকদের অধিকার৷

এমন সব দাবি ও কাজ করার আগে শ্রমিকদের নিজেদেরকে সাজিয়ে নেওয়া৷ নিজেদের এখনকার অবস্থাটা বুঝে নেওয়া৷

এখন শ্রমিকরা নানা ভাগে ভাগ হয়ে আছেন৷ তাদেরকে ভেঙে ভেঙে দেওয়া হয়েছে৷ পুঁজি এবং রাষ্ট্র এমনটি বানিয়ে ফেলেছে৷ ভাগাভাগির নামগুলি বললেই বোঝা যাবে৷ একই ধরনের কাজে স্থায়ী শ্রমিক, অস্থায়ী শ্রমিক৷ একই ধরনের কাজে কারখানার ভিতরে শ্রমিক, কারখানার বাইরে শ্রমিক৷ একই কারখানার ভিতরে স্থায়ী শ্রমিক, অস্থায়ী শ্রমিক৷ একই কারখানার ভিতরে একই কাজে স্থায়ী শ্রমিক, অস্থায়ী শ্রমিক৷ একই কারখানার ভিতরে সব সময় কাজ দেওয়া স্থায়ী শ্রমিক, সব সময় কাজ না দিয়ে মাঝে মাঝে বসিয়ে রাখা স্থায়ী শ্রমিক৷ ‘দক্ষ’ শ্রমিক, ‘অদক্ষ’ শ্রমিক৷ শিক্ষনপ্রান্ত শ্রমিক৷ সংগঠিত শ্রমিক, অসংগঠিত শ্রমিক৷ পুরুষ শ্রমিক, নারী শ্রমিক৷ পূর্ণবয়স্ক শ্রমিক, শিশু শ্রমিক৷ ভ্রাম্যমান শ্রমিক৷ দেশান্তরী শ্রমিক৷ ‘দাস’ শ্রমিক৷ উত্পাদন শিল্প শ্রমিক, পরিষেবা শ্রমিক, নির্মাণ শিল্প শ্রমিক৷ শ্রম আইন সংজ্ঞার্থ মাফিক শ্রমিক, শ্রম আইন সংজ্ঞার্থ বহির্ভূত শ্রমিক৷ চালু কারখানার শ্রমিক, বন্ধ কারখানার শ্রমিক৷ বন্ধ কারখানার বেকার ভাতা পাওয়া শ্রমিক, বেকার ভাতা না পাওয়া শ্রমিক৷ শ্রমিক চিকিত্সা ব্যবস্থার আওতায় থাকা শ্রমিক, আওতায় না আসা শ্রমিক৷ বড়ো কারখানার শ্রমিক, ছোট কারখানার শ্রমিক৷ ট্রেড ইউনিয়নের আওতায় থাকা শ্রমিক, আওতায় না থাকা শ্রমিক৷ এই সব ভাগাভাগি করে শ্রমিক ঐক্য ভেঙে দেওয়া৷ একদলের বিপরীতে অন্য দলদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া৷ শ্রমিকদের সংঘবদ্ধতা নষ্ট করে দেওয়া৷ শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলায় বাধা তৈরি করা হচ্ছে৷

chhobi-11
ছবি ১১। চিত্তপ্রসাদ, ১৯৪৭

একটার পর একটা কারখানা বন্ধ করে দেওয়ায় শ্রমিক বসতি, শ্রমিক এলাকা পাল্টে দেওয়া, শ্রমিকদের সঙ্গে যারা শ্রমিক নন এমন এলাকাবাসীদের যোগাযোগ ভেঙে যাওয়া৷ শ্রমিকদের একটা অংশের গ্রামে চলে যাওয়া৷ একটা অংশের অন্য কাজে চলে যাওয়া৷ কারখানার কাজ না থাকায়, ছোট ছোট কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকা৷ তেমন আয় না হওয়ায় রোজগারের জন্য নানা কাজে অনেক সময় ধরে আটকে থাকা৷ শ্রমিক বসতির অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে যাওয়া৷ শ্রমিকদের একসাথে থাকার সুযোগ ক্রমশ কমে যাওয়া৷ ফলে শ্রমিক ঐক্য কমজোরী হয়ে যাওয়া৷ বড়ো দলের ট্রেড ইউনিয়নদের শ্রমিকদের পাশ থেকে সরে যাওয়া৷

এসব সত্যি৷ তবুও শ্রমিক বসবাস, শ্রমিক মন, শ্রমিক আন্দোলন, শ্রমিক বন্ধুতা, শ্রমিক ঐতিহ্য এসবও সত্যি৷ এই সব এবং আরও সব, যা আমার হয়তো জানা নেই, মিলিয়ে একটা সত্যিকারের শ্রমিক রাজনীতি৷ অন্য রকম শ্রমিক রাজনীতি গড়ে তোলা৷

একটা শব্দ কিংবা কথা আমাদের শোনানো হয় ‘সংস্কার’৷ এত দিনে আমরা বুঝে গেছি, যা যা পুঁজির পক্ষে করা, তার নাম দেওয়া ‘সংস্কার’৷ এবার আমরা বুঝি যা শ্রমের পক্ষে তা ‘সংস্কার’ নয় কেন? ‘সংস্কার’ করার দায় শুধু ক্ষমতাসীনদের কেন? প্রকৃত ক্ষমতাবান শ্রমিকরাও তো ‘সংস্কার’ করতে পারে৷ অন্য ধরনের রাজনীতি, প্রকৃত শ্রমিক রাজনীতি, রাজনীতিতে ‘সংস্কার’৷ শ্রমিক আন্দোলনে ‘সংস্কার’৷ শ্রমিক আন্দোলনের রাজনীতিতে ‘সংস্কার’৷ ‘সংস্কার’-এর উল্টে দেওয়া, পাল্টে দেওয়া ভাবনা৷ শ্রমিক ভাবনা৷

Aug 03 2015


Subhendu Dasgupta may be contacted at subhendu.dg@gmail.com

Your Comment if any