banner
left-barhomeaboutpast-issuesarchiveright-bar

মুক্ত-চিন্তার শত্রুদের বিরুদ্ধে সরব হবার এখনই সময়

পরিমল ভট্টাচার্য

একদিন আগেও যে বিষয়টা বেশ কিছুটা খিল্লির পর্যায়ে ছিল, তেমনটা আর রইল না। জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। সমাজটাকে এখনও যতটা সুস্থ আর সুবুদ্ধিময় বলে ভাবি আমরা কিছু মানুষ, ভাবতে চাই, সেই ভাবনার গালে আরেকটি সপাটে থাপ্পড়।

আশা করা যাক এক্ষেত্রে বিশেষ কিছুই হবে না, হাজতের কম্বল কিম্বা শৌচালয়ের মগ নিয়ে ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লিখতে হবে না কবিকে। হয়তো বা স্থানীয় রাজনীতির চাপে পড়ে যে কেস দেওয়া হয়েছে, রাজ্য রাজনীতির চোখ মটকানিতে তাতে ধামাচাপা পড়বে।

পুলিশের খাতায় কেস এক ধরণের বিষ আগাছা, সেই আগাছা রোপণ করা হল একজন নাগরিকের নামে, একটি কবিতা লেখার অপরাধে। আমাদের বিচারব্যবস্থার যে বিচিত্র শম্বূকগতি, এবং পরিস্থিতি যা, তাতে এই ধরণের মামলা দ্রুত নিস্পত্তি ঘটবে, বিচারক সংশ্লিষ্ট পুলিশকে ডেকে ভৎসনা করবেন, মামলা তুলে নেওয়া হবে, এমনটা না হওয়াই দস্তুর। খুব সম্ভব ধামাচাপা পড়ে যাবে। সেই ধামার নীচে থেকে যাবে আগাছার বিষাক্ত শিকড়বাকড়। প্রয়োজনে যে কোনো সময় তাকে জল হাওয়া দিয়ে বাঁচিয়ে তোলা যেতেই পারে। তখন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কোর্ট-ঘর করতে হবে অভিযুক্তকে। কৌঁসুলি, হিয়ারিং, অ্যাপিল, ব্রিফ, শমন, রুলিং ...

এমন দু-তিনজন ভুক্তভুগিকে চিনি, তাঁদের মধ্যে একজন বিশিষ্টও আছেন। মুশকিল হল, যত বিশিষ্টই হোক না কেন কেউ, দিনের পর দিন মাসের পর মাস মিডিয়ার পাদপ্রদীপ থাকে না। তারপরেও হিয়ারিং-এর ডেট পড়লে কোর্টে যেতে হয়। সেই কোর্টটা যদি হয় দূরের কোনো শহরে (এক্ষেত্রে যেমন) তাহলে নিরাপত্তার প্রশ্নটাও এসে পড়ে। এক্ষেত্রে মানুষটির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কাজকর্ম কীভাবে দফারফা হয়, সেটা হয়তো অনুমান করা যায়। তাঁর পরিবারের লোকেদের কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, আর্থিকভাবে কী ধরণের চাপ পড়ে, তার আন্দাজ সহজে পাওয়া যায় না। ধরে নেওয়া যাক যদি তেমন কিছু নাও ঘটে, যদি কেস ধামাচাপা পড়েও যায়, তাহলেও সম্ভাব্য হেনস্থার বিভীষিকা তার বিষাক্ত ছায়া ফেলে তাঁদের আগামী দিনগুলোয়। জীবনটাই বদলে যায়।

আর এই ব্যাপারটা খুব ভাল করেই জানে মৌলবাদীরা। ইটপাটকেল নিয়ে শুটিং-এর সেটে ঢুকে ভাঙচুর কিম্বা প্রদর্শনীতে ছবির ক্যানভাস ফালাফালা করার থেকেও ঢের বেশি মোক্ষম মামলা ঠুকে দেওয়া, কিম্বা পুলিশ দিয়ে ‘কেস খাইয়ে দেওয়া’। হ্যাপা নেই, খরচাও কম। এর ফলে মুষ্টিমেয় কিছু লোকজন প্রতিবাদ-টতিবাদ করবে, মিছিল-টিছিল করবে। তা করুক না, এতে করে প্রায় নিখরচায় একটি প্রান্তিক সংগঠন এবং দু-চারটি মুখ বিখ্যাত হয়ে উঠবে, তাদের জমি তৈরি হবে। কিন্তু মিছিল টক শো আর কদিন? তারপর একা একা কোর্টে দৌড়তে হবে না বাছাধনকে? কিম্বা সেই সম্ভাবনায় বিনিদ্র রাত কাটাতে হবে না? আর বেছে বেছে মামলাও ঠোকা হবে দূরের কোনো ছোট শহরের এজলাসে, যেখানে মিডিয়ার ওবি ভ্যান যায় না। ছুটিয়ে মারতে হবে অভিযুক্তকে। যদি সে লেখক হয় ইতিমধ্যে তার কলমের কালি জমাট বেঁধে যাবে, সৃজনকোষ কপালে উঠে যাবে বাপধনের।

আর এইভাবে একজন মানুষ ও তাঁর পরিবারের, তাঁর একশো হাজার অনুরাগী কিম্বা তাঁর মতো ভাষানগরের বাসিন্দা মুক্তচিন্তার হাজার হাজার মানুষের মনের শান্তি কেড়ে নিতে পারে, তাঁদের ভাবনার আকাশকে বিষিয়ে দিতে পারে একজন এক্সওয়াইজেড, একটি এবিসিডি শহরের থানায় গিয়ে, একটি ফুলস্কেপ কাগজে তিন টাকার ডটপেন দিয়ে একটি ভুলে ভরা অভিযোগ দাখিল করে।

এর প্রতিরোধ কীভাবে? মারের বদলা মার? আমি জানি না।

কিন্তু যে দেশে পাতা ঝরার মতো আত্মহত্যা করে চাষি আর আদিবাসী পত্রকারের যোনিতে পাথর ভরে ছেড়ে দেওয়া হয়, সে দেশে ‘সম্মান’-এর মতো বায়বীয় বিষয় নিয়ে কোটি কোটি টাকার মানহানির মামলা হয়, তার বিচারও হয়। সে দেশে একজনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবাবেগহানির অভিযোগ আমার শান্তি সুস্থিরতা কেড়ে নিয়েছে, আমার মুক্তচিন্তার আকাশকে বিষিয়ে দিয়েছে, আমার সম্ভাব্য বাকস্বাধীনতায় লাগাম পরিয়েছে - এই মর্মে যদি কয়েকশো মানুষ অভিযোগ দাখিল করে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে কয়েকশো থানায়? যদি কাঁথি থেকে বারাসাত সদর মহকুমা আদালতে মামলা দায়ের হয়?

বেশ কিছুকাল হল প্রকাশ্য সভায় নেতার মুখে কালি ছেটানোর জুতো ছোঁড়ার খবর আর শোনা যায় না, প্রতিবাদীকে পুলিশের হাতে তুলে দেবার বা ছেড়ে দেবার আগে একটু উত্তমমধ্যম দেবার স্ট্র্যাটেজি শুরু হবার পর থেকেই কি? মারের বদলা মার? আমি জানি না।

আইন কী বলে? মাত্রাবৃত্ত ছেড়ে বরং আইন পাঠ হোক কিছুকাল। এই ধরণের হেনস্থার শিকার মুক্তচিন্তার মানুষকে আইনি সাহায্য দেবার জন্য একটি তহবিল তৈরি হোক। আর বাকস্বাধীনতা নিয়ে প্রতিবাদগুলো আরেকটু প্রোৎসাহী হোক, সোম্বচ্ছরের হোক।

কেন জয়পুর লিটফেস্ট-এর সময় অরুন্ধতী রায়কে নাগপুর আদালতে ছুটতে হয় সাইবাবার পাশে থাকার জন্য, আর এই নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারিত হয় না, এই নিয়ে চর্চা হোক; কেন তসলিমা বিতাড়িত, কেন বইমেলায় রুশদি ব্রাত্য হলেন এবং তাঁকে মিথ্যাবাদী দেগে দিলেন গিল্ডের কর্তা, এই নিয়ে বরং আলোচনাসভা হোক পরের বইমেলায়। আর সম্ভব হলে, প্যাভিলিয়ানগুলো পানসারে, কালবুর্গী আর দাভোলকারের নামে হোক। তাঁদের রচনা বাংলায় অনুবাদের ব্যবস্থা হোক।

এসব হোক, অথবা অন্য কিছু। না হলে বাকস্বাধীনতা নিয়ে আমাদের প্রতিবাদগুলো বড়ই সুগন্ধি আর আল্ট্রা-থিন হয়ে যাবে, ফর্দাফাই হয়ে যাবে ইস্পাতের ফলায়। তার কারণ ফলা ক্রমশ ধারালো হয়ে উঠছে, তাতে শান দেবার শব্দ শোনা যাচ্ছে ঘরে বাইরে।

Frontier
Mar 23, 2017


Parimal Bhattacharya may be contacted at paribhatta@yahoo.com

Your Comment if any