banner
lefthomeaboutpastarchiveright

এখন, গ্রিসের একটি “গল্প”

ফারুক চৌধুরী

ইউরোপের ছোট্ট একটি দেশ গ্রিস আজ পৃথিবীর অগুণতি মানুষের আলোচনার বিষয়। নানা বিতর্কও চলছে গ্রিসকে নিয়ে। কারণ কী এত আলোচনা, এত বিতর্কের?

প্রথমেই যে জবাব পাওয়া যাবে এ প্রশ্নের, তা হচ্ছেঃ কর্জ। কর্জে জর্জরিত গ্রিস কর্জদাতা ও লগ্নিকারী ব্যাংকগুলোর কর্জ শোধ করতে পারছে না। এই কর্জ পরিশোধ করতে গিয়ে গ্রিসের মানুষের জীবনমান নেমে এসেছে তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোর গরিব মানুষদের জীবনমানের স্তরে। কর্জের অর্থ আদায়ে কর্জদাতা ব্যাংকগুলো তাদের রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কঠিন সব শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিল গ্রিসের ওপর। এসব শর্ত এমন ছিল যে, সেগুলো ছিল ডাকাতি ও লুটের নামান্তর।

এ উদ্দেশ্যে তারা চালায় এমন হুকুমদারী, যেটাকে গ্রিসের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণই বলা যায়। এরই এক পর্যায়ে, গ্রিসে সরকারও পরিবর্তন করে ব্যাংকমালিকরা। একটি নির্বাচিত সরকারকে কার্যত বলপূর্বক হটিয়ে ক্ষমতায় বসায় একটি অনির্বাচিত সরকারকে। এটা ছিল ব্যাংক মালিকদের গণতন্ত্র-চর্চা। ঘটনা প্রবাহে, গ্রিসের জনগণ এসব কুকীর্তি ও নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করেন; নির্বাচন হয়; নির্বাচিত হয় ব্যাংক মালিকদের চাপিয়ে দেয়া শর্তগুলোর বিরোধী একটি রাজনৈতিক জোট। এখানেই শুরু হল নাটকীয়তার নতুন পর্যায়।

বামপন্থী যে জোটটি নির্বাচিত হয়, সে জোটের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল ব্যাংক মালিকদের চাপিয়ে দেয়া নিষ্ঠুর ও লুটের ব্যবস্থাগুলোর বিরোধিতা করবে, গ্রিসের ওপর ব্যাংক মালিকদের হুকুমদারী বন্ধ করবে।গ্রিসের জনসাধারণও সেটাই চাচ্ছিলেন। নির্বাচিত এ সরকার ব্যাংক মালিকদের সাথে আলোচনা শুরু করে। এ আলোচনা চলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান দেশগুলোর সাথে। আলোচনায় ব্যাংক মালিকদের শর্তগুলো শিথিল হয় না।

এ অবস্থায় গ্রিস সরকার এ সব বিষয়ে জনগণের মতামত নেয়ার জন্য গণভোট আয়োজন করে। গণভোটে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় হয় ব্যাংক মালিকদের কঠোর সব শর্ত প্রত্যাখ্যানের পক্ষে। এতে ব্যাংক মালিকরা শংকিত হয়ে ওঠে।

এর পরবর্তী আলোচনায় ব্যাংক মালিকরা আরো কঠোর শর্ত দেয়। গ্রিসে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম প্রায়-বন্ধ রাখে সরকার। সারা ইউরোপের অর্থনীতি ত’ বটেই, বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতিতেই বিরাজ করে অনিশ্চয়তা ও আশংকা। সবারই সামনে প্রশ্ন ছিলঃ কী ঘটবে? এর পরে, আকস্মিকভাবে গ্রিস সরকার ব্যাংক মালিকদের সব শর্ত মেনে নেয়। এবারের মেনে নেয়া শর্তগুলো আগের শর্তগুলো থেকে কঠোর। গ্রিসের রাষ্ট্রযন্ত্রেও চাপে নতুন নানা নিয়ন্ত্রণ। বিস্ময়কর ঘটনা যেন!

এ ঘটনাধারা বিশেষভাবে ও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের দাবী রাখে। প্রয়োজন দেখা দেয় বিষয়টি অধ্যয়নের। কারণ, এ ঘটনাধারায় কেবল পুঁজিবাদী অর্থনীতি নয়, সেই সাথে পুঁজিবাদী বা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের একটি বর্তমান অবস্থাও ফুটে উঠেছে। এ ঘটনাধারাকে একেবারে সংক্ষেপে নিম্নরূপে ব্যক্ত করা যায়ঃ

১. কর্জ সংকট গ্রিসে ব্যাংক সংকটে রূপ নেয়, যা দেশটির পুরো অর্থনীতিতে সংকট হিসেবে দেখা দেয়। এ সংকটের ফলে প্রধানত দালানকোঠা নির্মাণ শিল্প ধসে পড়ে, যা পরবর্তীতে অর্থনীতির অন্যান্য খাতে ছড়িয়ে যায়। ফলে দেখা দেয় বেকারত্ব, ব্যাংক কর্জ পরিশোধে অসামর্থ। এর ফলে, কর্জ আদায়ে ব্যাংক মালিকরা রাষ্ট্রের খরচ কমানোর ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়। ফলে কল্যাণমূলক ব্যবস্থাগুলো ভেঙ্গে পড়ে, দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। এক দিকে, বেকারত্ব, অপর দিকে, কল্যাণমূলক ব্যাবস্থা ভেঙ্গে পড়া আপামর মানুষকে ঠেলে দেয় অভাবে-দারিদ্র্যে-অনাহারে-চিকিৎসার সুযোগহীনতায়-শিক্ষার সুযোগ হারানোয়। এটা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিষ্ঠুর চরিত্র তুলে ধরে। এটা দেখিয়ে দেয় যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিজের সংকটকে জনসাধারণের ওপর চাপিয়ে দেয়। এবং এভাবে নিজে সংকট থেকে উদ্ধার পাবার চেষ্টা চালায়।

২. অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা ত বটেই, নিজেদের স্বার্থ হাসিলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা রাষ্ট্রযন্ত্রকে কিভাবে ব্যবহার করে, তার সাম্প্রতিক উদাহরণ গ্রিস। তবে, বাংলাদেশের প্রগতিশীল কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ লিখে থাকেন যে, রাষ্ট্র পেছনে চলে যায় বা গৌণ ভূমিকা নেয়। এদের এ বক্তব্য যে কতটা হাস্যকর, তা গ্রিসের ঘটনা প্রবাহ দেখলে বুঝতে পারা যায়।

এই রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যাংক মালিকরা গ্রিসে কতগুলো কাজ করে। তারা গুড়িয়ে দেয় জনগণের প্রতিরোধ ক্ষমতা, লুট করে নেয় জনগণের সম্পদ। আর, সব চেয়ে বড় যে কাজটি তারা করে, সেটা তারা আগে বহুবার করেছে। সে কাজটি হচ্ছেঃ একটি দেশের সার্বভৌমত্ব গুড়িয়ে দেয়া। তারা আরেকবার প্রমাণ করেছে যে, পুঁজির কাছে দেশের সীমানা, সার্বভৌমত্ব, এসব কিছুই নয়।

৩. গ্রিসের ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ফাটল, বিভেদ, বিরোধ কত প্রবল-বিস্তৃত-গভীর। এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বলা যেতে পারে ইউরোপে পুঁজির এ যাবৎকালের সব চেয়ে বড় প্রকল্প। এ ব্যবস্থাটি কত নাজুক, কোথায় নাজুক, তা-ও দেখিয়ে দিয়েছে গ্রিসের ঘটনা।

৪. গ্রিসের ঘটনাধারা আলোচনা করার সময়ে একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সেটি হচ্ছে সমগ্র আলোচনাকে অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলোর মধ্যে গণ্ডীবদ্ধ রাখা। কিন্তু, গ্রিসের ঘটনাবলীই দেখিয়ে দেয় যে, জনগণের তরফে আলোচনা-বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যার সময় বিষয়টি রাজনৈতিক এবং কেবল রাজনৈতিকই নয়, বিষয়টি গণতান্ত্রিক অধিকার ও আন্দোলন সংশ্লিষ্ট এবং জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা সংক্রান্ত।

৫. আজ ধনীদের বিশ্ব-ব্যবস্থায় সংকটের যুগে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের অবস্থা কেমন দাঁড়াচ্ছে, সেটাও দেখিয়ে দেয় গ্রিসের ঘটনাবলী। রাষ্ট্র “নিরপেক্ষ”, রাষ্ট্র “সকলের উর্ধ্বে”, রাষ্ট্র “নিজেই চলে”, এমন নানা কথা ও তত্ত্ব সরাসরি বা ঘোরপ্যাঁচ দিয়ে বলা হয়। কেবল গ্রিস রাষ্ট্র নয়, অন্যান্য কয়েকটি রাষ্ট্রও দেখিয়ে দিয়েছে এ সব তত্ত্ব, ভাবনা, কল্পনা ভুল। এ ঘটনা-সম্মিলন থেকে বুঝতে পারা যায় যে, সর্বজনীন, শ্রেণী-নিরপেক্ষ গণতন্ত্র বলে কিছু নেই, যদিও অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও নানা বামপন্থী-প্রগতিশীল-জনগণপন্থী রাজনীতিবিদ-তাত্ত্বিকের কথায় ও লেখায় তা মাঝে-মাঝেই ফুটে ওঠে।
গ্রিসের ঘটনাধারা আরো দেখিয়ে দেয় যে, ধনীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি জনগণের গণতন্ত্রচর্চা ন্যূনতম পর্যায়েও সহ্য করতে একেবারেই অনিচ্ছুক।

৬. গ্রিসের ঘটনার ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্যও রয়েছে। এখনকার বিশ্ব ব্যবস্থার মোড়লদের কাছে গ্রিসের ঘটনা আশংকাজনক। এ আশংকা এখনো কাটে নি।

দেখায় ছোট, এমন দেশ বা অর্থনীতিও আজকের বিশ্ব ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। গ্রিসের ঘটনাবলী সেটাও দেখিয়ে দিয়েছে। আশংকা দেখা দিয়েছিল যে, গ্রিসের ঘটনা প্রবাহ এমন রূপ নিতে পারে, যা আজকের বিশ্ব ব্যবস্থার মোড়লদের বিশ্ব রণনীতিগত কয়েকটি দিককে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারতো।

নিজেদের অবস্থা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার জন্য এ বিষয়গুলো লক্ষ্য করা এবং এ সবের তাৎপর্য অনুধাবন করা দরকার। জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা নেয়ার লক্ষ্যেই দরকার বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা।

কামান-বন্দুক-ট্যাংক নিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয় বলেই ধারণা হয়েছে। কিন্তু, গ্রিসের ঘটনাধারা দেখিয়ে দিয়েছে ঐসব ছাড়াও অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে আজকের টাকাঅলারা। বলা হচ্ছে, ব্যাংক মালিকরা সর্বশেষ যে চুক্তি করতে বাধ্য করেছে গ্রিসের সরকারকে, তা কার্যত একটি অভ্যুত্থান। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আছে, নির্বাচিত আইন সভা কাজ করছে, অথচ অভ্যুত্থান হয়েছে, অভ্যুত্থানকারীদের নির্দেশ অনুসারে, তাদের নির্দিষ্ট করে দেয়া সময়সূচী অনুসারে তাদের নির্দিষ্ট করা কাজগুলো করতে হয়েছে ও হচ্ছে গ্রিসের আইনসভাকে ও সরকারকে।

ফলে কি দেখা গেল গ্রিসে? দেখা গেল যে, জন্মনিয়ন্ত্রণের উপকরণ থেকে শুরু করে ঠোঁট রাঙানোর লিপস্টিক বা অধররঞ্জনী, লাশ বহনের বা দাফনের কফিন বাক্স থেকে শুরু করে রুটি আর সোনা-জহরতের অলংকার, জীবনের দরকারি-অদরকারি সবের দাম নির্ধারণ করছে ব্যাংক-সাহেবরা।

কাজের লোকেরা সপ্তাহে ছ দিন কাজ করে সপ্তম দিন রবিবারে বিশ্রাম নেবেন, ছুটি কাটাবেন, বেড়াতে যাবেন বা ধর্মকর্ম করবেন। এ নিয়মই চলে আসছিল গ্রিসে, অন্যান্য দেশেও। ব্যাংক সাহেবরা বলে দিলেনঃ না, এখন থেকে গ্রিসে রবিবার দোকানপাট খোলা থাকবে, কাজ করতে হবে। তার মানে দাঁড়াল মানুষ কবে কতটুকু কাজ করবেন, তাদের বেড়ানোর বা বিশ্রামের বা অবকাশের বা ধর্মকর্ম করার সময় থাকবে কি-না, সেটাও নির্ধারণ করে দিল ব্যাংক মালিকরা তাদের চুক্তির মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে।

কোথায় কতটুকু মূল্য সংযোজন কর বসানো হবে, সেটাও নির্ধারণ করে দিচ্ছে ব্যাংক মালিকরা তাদের শক্তির মাধ্যমে, যা বাস্তবায়িত হচ্ছে চুক্তি অনুসারে। সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে সব দ্রব্যের মূল্য বাড়বে। অর্থাৎ, কে কতটুকু ভোগ করবেন, তা-ও নির্ধারণ করে দিচ্ছে এই মালিকরা।

কর্জ শোধ করার জন্য গ্রিসের নানা সম্পদ বিক্রি করতে হবে। এই বিক্রির অর্থ জমা হবে একটি তহবিলে। সে তহবিলের অর্থ যাবে কর্জ শোধ করতে। এমন নানা শর্ত পালনে আইন করতে হবে। আইনের ভাষা কী হবে, কত দিনের মধ্যে আইন পাস করতে হবে, এ সব বিষয় নির্ধারণ এবং যাচাই করবে ব্যাংক মালিকদের পক্ষের লোকেরা। এ সব ব্যবস্থা অন্তত ছয়টি দেশের পার্লামেন্টে যাচাই-বাছাই অনুমোদিত হতে হবে। এ সব হচ্ছে গ্রিসে ব্যাংক মালিকদের সংগঠিত অভ্যুত্থানের কার্যক্রম। কেমন গণতন্ত্র, কেমন সার্বভৌমত্ব, কেমন স্বাধীনতা, তা বুঝতে কি অসুবিধা হয়?

প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, কেন এমন হলো? কারণ ত নিশ্চয়ই রয়েছে? ভবিষ্যতে সুযোগ হলে সে বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।     

Sep 04 2015


Farooque Chowdhury may be contacted at farooque_chowdhury@yahoo.com

Your Comment if any