banner
left-barhomeaboutpast-issuesarchiveright-bar

আজকের সঙ্কট এক বড় ভূমিকম্পের মত, যার উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে সংঘের ইতিহাস ঘাঁটলে

- বললেন তনিকা সরকার

প্রতিবেদক - বিশ্বজিৎ রায়

শনিবার পিপলস স্টাডি সার্কেল আয়োজিত ‘ফ্যাসিবাদ, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম’ নিয়ে চলতি বক্তৃতামালায় ক্লাস নিতে এসেছিলেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার। দেশজুড়ে বাড়তে থাকা ফ্যাসিবাদী পরিমণ্ডলে মানুষের ওপর ক্রমাগত শারীরিক, আর্থ-সামাজিক ও মতাদর্শগত আক্রমণের মুখে মে মাসে শুরু হওয়া এই বক্তৃতামালা ও স্টাডি-ক্লাস গুলি চলবে বছরভর। এতে অংশ নিচ্ছেন সমাজকর্মী, ছাত্র, শিক্ষক, চাকুরিজীবি, গবেষক প্রভৃতি নানা ধরণের মানুষ। শনিবারের চার-ঘন্টা ব্যাপী ক্লাস ও আলোচনার বিষয় ছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ইতিবৃত্ত এবং সঙ্ঘ পরিবারের নারীবাহিনীর প্রসঙ্গ। এই রিপোর্টে রইল তারই অতি সামান্য কিছু ঝলক।

সঙ্ঘের ইতিহাস ও মতাদর্শ
সঙ্ঘ-নিয়ন্ত্রিত বিজেপি-র ভারত-বিজয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনজয়ী আর দশটা রাজনৈতিক দলের উত্থান ও বিস্তারের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তা বোঝাতে ভারতীয় রাষ্ট্র ও সমাজকে আমূল বদলানোর লক্ষ্যে বৃটিশ আমল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সঙ্ঘ পরিবারের আগ্রাসী মতাদর্শ ও সংগঠন প্রসারের নানা পর্যায়, নির্ণায়ক মোড় ও ওঠানামার দীর্ঘ কালানুক্রমিক রূপরেখা হাজির করলেন প্রবীণ ইতিহাসবিদ।

সেই রূপরেখায় সাভারকর- হেডগেওয়ার- গোলওয়ালকর থেকে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মতাদর্শে প্রাণিত, শুরুতে মূলত মহারাষ্ট্রীয় চিতপাবন ব্রাহ্মণদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সঙ্ঘের হিন্দু জাতীয়তাবাদের মতাদর্শে বাংলার সবচেয়ে বড় অবদান বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’। ক্ষয়িষ্ণু মুসলমান রাজশক্তির সঙ্গে যুদ্ধ আর উদীয়মান রাজশক্তি ইংরেজের সঙ্গে মৈত্রীর এই হিন্দু ভাবাদর্শ সম্পূর্ণতা পেল দেশমাতৃকাকে হিন্দু দেবী মহাশক্তি বা দুর্গা রূপে বর্ণনায়। শুরুতে যা ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বর্ণহিন্দুর সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কল্পনা তা একটি রাজনৈতিক চেতনা তথা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রূপকল্পে পরিণত হল তিলকের মতো চরমপন্থী ব্রাহ্মণ কংগ্রেস নেতাদের বদান্যতায়। শিবাজি উৎসব, গণেশ চতুর্থীকে জনপ্রিয় করা হল কট্টর মুসলমান সম্রাট আলমগীরের বীর প্রতিস্পর্ধী এবং প্রাচীন হিন্দু সাম্রাজ্যের পুনরুত্থানের প্রতীক রূপে। বিংশ শতকের প্রথম দিকে বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লিগের জন্ম, মুসলমানদের আলাদা প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি প্রশ্নে উপমহাদেশের নানা প্রান্তে দফায় দফায় দাঙ্গা সেই বিদ্বেষকে মান্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা দেয়।

শুরু থেকেই এই হিন্দু জাতীয়তাবাদ শুধু মুসলমান-বিদ্বেষী নয়, আর্য জাত্যাভিমানী, বর্ণাশ্রমবাদী ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের ধারক যা শূদ্র ও অন্ত্যজদের উপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। উপনিবেশবাদের সঙ্গে দাম্পত্য কলহের যুগে উত্তর ভারতে উনিশ শতকি হিন্দু ধর্মসংস্কার বা শুদ্ধি আন্দোলন-সংগঠনগুলি— আর্য সমাজ ও সনাতন ধর্ম সংসদ প্রভৃতি ‘নিচু’ জাতের মধ্যে থেকে উঠে আসা সংস্কার আন্দোলনগুলিকে হয় নস্যাৎ করেছে নয় তাদের আত্মসাৎ করে বিষ দাঁত ভেঙে দিতে চেয়েছে। আজ এরা আম্বেদকরকে হিন্দু আইকন বানানোর অপচেষ্টা করলেও দলিতদের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধিকারের জন্য তাঁর লড়াইয়ের এরা ছিল কট্টর বিরোধী। আবার পেরিয়ারের জাতিবিরোধী, পিতৃতন্ত্রবিরোধী, নাস্তিক র‍্যাডিকাল আন্দোলনকে এরা বহু চেয়েও কোনোভাবেই গিলতে পারেনি।

একদিকে গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী খিলাফত ও পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলনগুলিতে হিন্দু-মুসলমান জনতাকে ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে মেলানোর প্রচেষ্টা এবং অন্যদিকে কমিউনিস্ট ও আম্বেদকরপন্থীদের কখনও মিলিত কখনও পৃথক শ্রমিক-কৃষক সংগ্রাম প্রয়াসগুলিতে এরা প্রমাদ গুনেছে। হিন্দু পুনরুত্থানবাদের প্রধান সামাজিক ভিত্তি—বর্ণহিন্দু, স্বচ্ছল বা মধ্যবিত্ত যুবকেরা যত বেশি সম্মিলিত স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়েছেন, তত এরা জাতীয়তাবাদের এক কট্টর হিন্দু বয়ান তৈরি করেছে।

ভারতীয়তা= হিন্দুত্ব
ভারতীয়তা আর হিন্দুত্বকে সমার্থক বানিয়ে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের সঙ্ঘী তত্ত্ব হিন্দু সহিষ্ণুতা ও বহুত্ববাদের গুণ গাইলেও তা আসলে প্রাচীন হিন্দুত্বের এক অতিকথানির্ভর মর্মবস্তু নির্মাণ করে সেটাকেই শাশ্বত ভারতের জীবনবোধ তথা ধর্মচেতনা করে চালাতে চায়। এতে এদেশের অন্যান্য ধর্ম ও সংস্কৃতির স্বীকৃতি দূরে থাক, কালের ধারায় প্রবাহিত বর্ণাশ্রমভিত্তিক হিন্দু সমাজের নানা স্তরে ধর্ম ও সংস্কৃতির বহু স্বরের ইতিহাস পর্যন্ত ধামাচাপা পড়ে যায়।
ভারতভূমির উপর দেবীমূর্তি আরোপ করে রাষ্ট্রভক্তি, দেশভক্তি আর ধর্মভক্তিকে একাকার করে দেওয়ার এই প্রকল্পের জেরেই আজ সঙ্ঘ-বিরোধী মাত্রেই দেশদ্রোহী, রাষ্ট্রদ্রোহী বলে চিহ্নিত। অথচ ইতিহাস বলে সঙ্ঘ পরিবার ইংরেজ-শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেয়নি। একটি নেতাও জেল খাটেনি। শুধু তাই নয়, রাজশক্তির দোসর হিসেবে কাজ করেছে। তাদের তাত্ত্বিক নেতা, হিন্দু মহাসভার জনক সাভারকর প্রথম যৌবনে চরমপন্থী ধারায় যোগ দিলেও পরে ইংরেজের কাছে নাকখত দিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করে কারামুক্ত হন। বাকি জীবন কাটান গান্ধী তথা কংগ্রেসের সন্মিলিত ভারতীয়তার বিরোধিতায় এবং হিন্দুত্ববাদী উন্মত্ততা প্রচার ও সংগঠনে। গান্ধী-হত্যাকারী নাথুরাম গডসে থেকে সঙ্ঘচালকরা তার মন্ত্রশিষ্য। বৃটিশবিরোধী লড়াইয়ের পর্বে আর-এস-এস ছিল একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন যে কোনোদিন বৃটিশ শাসকের কোনোমাত্র তোপ বা দমনের মুখে পড়েনি। একদিনের জন্যও না।

ক্টোপাসের বাঁধন
আজকের ক্ষমতাসীন সঙ্ঘ পরিবার অক্টোপাসের থেকেও বেশি বাহুর বাঁধনে শিকারকে পেঁচিয়ে ধরছে, তা সে ব্যক্তি হন বা গোষ্ঠী, শিশু বা বৃদ্ধ, নারী বা পুরুষ বা তৃতীয়লিঙ্গ। দেশ জুড়ে ছড়ানো সঙ্ঘের শাখা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ বিদ্যালয়ের নেটওয়ার্ক ও তার বিস্তার কলেজে শিশু থেকে তরুণদের প্রতিদিন ধারাবাহিক মগজ ধোলাইয়ের ব্যবস্থা। গল্পের জনপ্রিয় ফর্ম ব্যবহার করে ইতিহাসকে ক্রমাগত বিকৃত করা। আদিবাসী-দলিত থেকে শ্রমিক–কৃষক, সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, পেশাদার, বিজ্ঞানী এবং নারীদের জন্য আলাদা আলাদা সংগঠন। প্রতিটি মহল্লায় শাখায় কসরতে দিন শুরু করে বজরং দলের আখড়ায় যুবকদের ধর্মযুদ্ধের প্রস্তুতি, দিনান্তে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মন্দিরে ভজনা। এই নেটওয়ার্কের কাঠামো ও প্রাত্যহিক কার্যকলাপ নিয়ে তাঁর নিজের ও তাঁর ছাত্রদের ফিল্ডওয়ার্কের ভিত্তিতে দীর্ঘ বিবরণ রাখেন অধ্যাপক তনিকা সরকার।

নারী=গর্ভ=অস্ত্রাগার
গৃহই মেয়েদের আদর্শ স্থান এটাই সনাতনী শিক্ষা হলেও সঙ্ঘ ধর্মযুদ্ধে মেয়েদের সক্রিয় ভাবে সামিল করেছে। যদিও আর-এস-এস এখনও একটি সম্পূর্ণভাবে পুরুষ-অধ্যুষিত সংগঠন তবু নারীদের জন্য সমান্তরাল কিন্তু আলাদা শাখা-প্রশাখার ব্যবস্থা করেছে তারা। এই প্রসঙ্গে উঠে এল সংঘ পরিবারের মতাদর্শের চূড়ান্ত নারীবিরোধী অবস্থানের প্রেক্ষিতে মহিলাদের হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের কাজে সামিল করার ক্ষেত্রে যে অবশ্যম্ভাবী দ্বন্দ্ব ও সে দ্বন্দ্বের (তাদের মত করে) নিরসনের ক্ষেত্রে তাদের ব্যবস্থাগ্রহণের নানা ইন্টারেস্টিং তথ্য। বাবরি ধ্বংস থেকে গুজরাত দাঙ্গায় নারীদের অংশগ্রহণের নমুনা মিলেছে। সীতা-সাবিত্রী- দময়ন্তীর উত্তরসূরিদের শেখানো হয় পরিবারের ভিতরে পুরুষ ও সমাজ অভিভাবকদের প্রশ্নাতীত ভাবে মান্য করতে।

মেয়েদের স্বাধীন মন তো দূরের কথা স্বাধীন শরীর হিসেবেও বিবেচনা করে না যে মতাদর্শ। স্রেফ তাদের ‘কোঁখ’ তথা গর্ভকে একটি অস্ত্রাগার বিবেচনায় তাদের দশটি করে সন্তানের জন্মদান এবং ধর্মযোদ্ধাদের কচি বয়স থেকেই পরবর্তী প্রজম্মের উপযুক্ত শিক্ষা-সংস্কার নিশ্চিত করায় উদ্বুদ্ধ করা হয়। হ্যাঁ, ‘মায়ের জাত’কে বারবার বলা হয়, কি ভাবে ‘ওরা’ মানে মুসলমানরা যুগের পর যুগ হিন্দু মেয়েদের ‘রেপ’ করেছে। ‘লাভ জিহাদের’ চিত্রকল্পের বিচিত্র স্ক্রিপ্ট শুনিয়ে মগজধোলাই করা হয়, যার মাধ্যমে মুসলমানরা নাকি হিন্দু মেয়েদের ফুসলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বদলা নিতে ‘ওদের’ মেয়েদের ‘রেপ’ করায় যে অন্যায় নেই তা তো গুজরাত-এই প্রমাণ হয়ে গেছে। মেয়ে বলে কি ধর্ম নেই? তাই ধর্মযুদ্ধে সামিল দুর্গা বাহিনীর অস্ত্রশিক্ষাও চলছে। এই প্রসঙ্গে তিনটি ডকুমেন্টারি ছবি (ললিত ভাচানি-র ‘দ্য বয় ইন দ্য ট্রি’, ‘দ্য মেন ইন দ্য ব্রাঞ্চ’, নিশা পাহুজার ‘দ্য ওয়ার্ল্ড বিফোর হার’) নিয়েও আলোচনা করেন অধ্যাপক সরকার।

রাম ও বাম
সঙ্ঘ পরিবারের ইতিহাস ও গত কয়েক দশকের কার্যকলাপ নিয়ে আরও অনেকের সঙ্গে তনিকাদির গবেষণা সুপরিচিত। সঙ্ঘীদের কাছে তিনি ও সমমনস্ক বামপন্থী-উদারপন্থী ইতিহাসবিদরা অনেকদিনই বিষবৎ পরিত্যাজ্য। রাইসিনা পাহাড়ে মোদির অভ্যুদ্যয়ের পর তাদের বই অথবা বইয়ের পরিচ্ছেদ স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির পাঠ্যতালিকা থেকে লাগাতার ছাঁটাই হচ্ছে। অন্যদিকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে বাম সরকারের সমালোচনা করায় তিনি, সুমিত সরকার ও সুমিত চক্রবর্তীর মতো কয়েকজন মুক্তবিবেক বুদ্ধিজীবী-গবেষক সরকারি বামপন্থীদের বিরাগভাজন হন।

দীর্ঘ বাম-শাসন পর্বে পশ্চিমবাংলায় সঙ্ঘের প্রসার সম্পর্কে বলতে গিয়ে তনিকাদি জানালেন, সে সময় ভঙ্গবঙ্গে সঙ্ঘের বিস্তার সম্পর্কে সতর্ক করতে এসে তাঁকে তৎকালীন শাসকদের ঔদাসীন্য আর আত্মসন্তুষ্টির সামনে পড়তে হয়েছে। অথচ ক্ষমতা থেকে অনেক দূরে থাকাকালীন নয়ের দশকের গোড়াতেই এ রাজ্যে সঙ্ঘের হাজার খানেক শাখা, ২১,০০০ প্রশিক্ষিত কর্মী ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির হোলটাইমারদের মতো সঙ্ঘের মূল সংগঠক বা প্রচারকরা পেতেন মাসে ৫০০ টাকা। অধস্তন বিস্তারকেরা ২৫০ টাকা। উত্তরে চা-বাগান শ্রমিকদের মধ্যে সেবামূলক কাজ থেকে দক্ষিণে, আদিবাসী অঞ্চলে ন্যূনতম সরকারি স্কুলের পরিষেবা থেকেও বঞ্চিত শিশুদের জন্য স্কুলের মাধ্যমে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের প্রতি ঘৃণা ও হিন্দু আধিপত্যবাদী মতাদর্শ ছড়িয়েছেন তারা। শয়তানকে তার প্রাপ্য দাও—এই মনোভাব থেকে এবং বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি ইতিহাসবিদের দায় মনে রেখে ফান্ডিং সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন, স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ সরকার ও পশ্চিম ভারতের রাজন্যবর্গ এবং তারপর দেশের শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের থেকে টাকা পেলেও ক্ষমতাহীনতার দিনে সঙ্ঘ মূলত প্রচারকদের নিষ্ঠানির্ভর ছিল। এদের অধিকাংশ ব্রাহ্মণ ও অন্য উঁচু জাতের, সম্পন্ন ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা।

তনিকাদির প্রশ্নঃ রাজনৈতিক ক্ষমতাহীন দিনে সঙ্ঘ কর্মীরা যদি ওদের গড় উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্য থেকে দূরে এভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, তাহলে বামেরা তাদের একদা-দুর্গগুলি থেকে দূরের রাজ্যগুলিতে সেই লাগাতার সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রয়াস নিল না কেন? কোথায় গেল পুরোন কমিউনিষ্ট আদর্শবোধ? কেন আজ শুধুমাত্র ক্ষমতায় ফেরার হাঁকপাঁক? একই বছর, ১৯২৫ সালে আর-এস-এস আর কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম - একথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি কার্যত গোটা দেশে ক্রমশ দুর্বল বামপন্থীদের গভীর আত্মসমীক্ষার ডাক দিলেন। যাদের শোনার কথা তারা শুনবেন কী?

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিরোধ গড়তে বাম- কংগ্রেস কোথায়?
গৌরী লঙ্কেশের নৃশংস হত্যাকান্ডে হিন্দুত্ববাদীদের ফ্যাসিস্ত চরিত্র আরও একবার নগ্নভাবে উন্মোচিত। হিটলার-মুসোলিনির ঘোষিত ভক্ত আর এস এস তথা সঙ্ঘ পরিবারের ঠ্যাঙ্গাড়ে ও গুপ্তঘাতক বাহিনী যে কোনও ভিন্নমত ও প্রতিবাদের গলা টিঁপে ধরছে। আজকের সঙ্কটের তুলনা করলেন তিনি বড় ভূমিকম্পের সময় ছোট-ছোট কিন্তু লাগাতার ভূ-কম্পন (ট্রেমর)-এর সঙ্গে। রোজ একটা না একটা নতুন আঘাত নামানো হচ্ছে পরিকল্পিত কায়দায়। রোজ একেবারে নতুন ফ্যাশনে চোখধাঁধানো নতুন কিছু না কিছু আক্রমণ। একদিন নোটবন্দীর মত নিদারুণ আর্থিক আঘাত তো পরেরদিন কাউকে মাঝরাস্তায় কুপিয়ে মারা। একদিন কৃষকদের ওপর গুলি চালানো তো পরেরদিনই কোনও ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রদের ওপর হামলা। একদিন দলিতদের লাঠিপেটা করা তো পরের দিন বৈবাহিক ধর্ষণকে পুনয়ার গ্রাহ্যতা দেওয়া। তদুপরি নির্লজ্জ ভাবে টিভি চ্যানেল গুলোকে কিনে নিয়ে লাগাতার হত্যা-হামলা নিয়ে উল্লাস। প্রতিবাদ করলেই হয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষা কায়দায় মুখ বন্ধ করে দেওয়া নয়তো খুন। এই লাগাতার ভূ-কম্পন হওয়ার দুটি ফল হচ্ছে – এক, মানুষ ধীরে ধীরে হামলার মাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। দাভোলকরের হত্যায় যা অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল, আজ অনেকগুলো চোখধাঁধানো গুপ্তহত্যার পরে তা রোজকার ঘটনা হয়ে উঠছে। দুই, মানুষকে সংগঠিত ও একজোট হওয়ার সময় দিচ্ছে না এই লাগাতার হামলাগুলি। একটিকে প্রতিরোধ করতে না করতে আরেকটি এসে হাজির, এবং এরই ফাঁকতালে হয়ে যাচ্ছে ভূমিকম্পের মত সমাজ-রাজনীতির এক বড়সড় রি-অ্যালাইনমেন্ট যা মানুষের নজর থেকে ঢেকে ফেলা যাচ্ছে। এমনই দমফাটা পরিস্থিতিই আজকের গভীর সংকট।

এসময় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে জনমত ও গণপ্রতিরোধ সংগঠিত করতে দেশ জুড়ে পথে নামা জরুরি। রাজনৈতিক ভাবে এ কাজে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নেওয়ার কথা ছিল বামেদের। কিন্তু তারা কোথায়? এক একটা খুন হচ্ছে আর সীতারাম ইয়েচুরিরা পাভলভিয়ান প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। সবচেয়ে বড় বিরোধী দল কংগ্রেসের অবস্থা তথৈবচ। আর-এস-এস প্রচারক প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভূমিকায় আমি বিস্মিত নই। কিন্তু বাম ও কংগ্রেস নেতাদের হাল দেখে আমি স্তম্ভিত এবং ক্রুদ্ধ। ফ্যাসিস্তদের আক্রমণের তীব্রতায় নয়, পাল্টা রাজনৈতিক প্রতিরোধের অভাবে প্রতিবাদীদের নিরাপত্তাহীনতার বোধ বাড়ছে। শনিবারের ক্লাসে তনিকা সরকার এভাবেই তাঁর ক্ষোভ জানালেন।

Frontier
Sep 19, 2017


Your Comment if any