banner
bangla-bar

 

কোভিড নাইনটিন, অর্থনৈতিক সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তন: পুঁজিবাদী দুর্যোগ

জন বেলামি ফস্টার: সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফারুক চৌধুরী।

করোনাভাইরাসের বিশ্বজোড়া মহামারীর প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাদের বর্তমান অবস্থা ও অর্থনৈতিক সংকট বিষয়ে বিখ্যাত সমাজতন্ত্রী সাময়িকী মান্থলি রিভিয়ুর সম্পাদক জন বেলামি ফস্টার আলোচনা করেছেন নিম্নোক্ত সাক্ষাৎকারে। মার্চ মাসের শেষভাগে গৃহীত এ সাক্ষাৎকারে ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে অনেক বইয়ের লেখক জন বেলামি ফস্টার পুঁজিবাদ, পুঁজিবাদের সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে বর্তমান মহামারীর সম্পর্কের ওপরে আলোকপাত করেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফারুক চৌধুরী।

ফারুক চৌধুরী: অনেক দিন ধরেই কার্ল মার্কসের মেটাবলিক রিফট বা প্রাণ-প্রতিবেশ-সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের ভাঙন সংক্রান্ত তত্ত্ব আপনি বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন। আপনার বিশ্লেষণের আলোকে করোনাভাইরাসের বিশ্বজোড়া মহামারীকে কিভাবে দেখেন?

জন বেলামি ফস্টার:  সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের আকস্মিক আবির্ভাব এবং কোভিড-১৯ বিশ্বজোড়া মহামারীর ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, সেটি আশঙ্কাজনক। এই অবস্থা, এর পেছনের কারণগুলো, দুটোই পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মার্কসের মেটাবলিক রিফট বা প্রাণ-প্রতিবেশ-সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের ভাঙন সংক্রান্ত তত্ত্ব একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি, যেটির মাধ্যমে প্রাণ-পরিবেশ-প্রতিবেশ-সমাজের মধ্যকার সম্পর্ক, বিশেষ করে সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যকার জটিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে অনুসন্ধান করা হয়। প্রায় একই তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে অনেক পরে সিস্টেমস ইকোলজি বা পরিবেশ-প্রতিবেশ-ব্যবস্থা-বিদ্যা বিকশিত হয়েছে। জার্মান রসায়নবিদ ইয়োস্টাস ভন লিবিগের গবেষণা থেকে মার্কস মাটির রাসায়নিক বিপাকীয় প্রক্রিয়ার ভাঙন বিষয়ে মনোযোগী হন। গ্রাম থেকে কয়েকশ মাইল, কখনো হাজার মাইল দূরের শহরে-নগরে খাদ্যশস্য ও আঁশ জাতীয় সামগ্রী পরিবহন করার ফলে মাটির প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান, যেমন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, ইত্যাদির ক্ষয় হয়; এই উপাদানগুলোর আর মাটিতে ফিরে যাবার কোনো উপায় তো থাকেই না, বরং এগুলো শহর-নগরকে দূষিত করে তোলে। এ ঘটনাই বৃহত্তর পরিধিতে প্রতিফলিত হয়, যখন পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পদের কেবলই নির্বিচার আহরণের মাধ্যমে, মার্কসের ভাষায়, “প্রকৃতির সর্বজনীন বিপাকীয় ক্রিয়া”য় ভাঙন তৈরি হয়।

করোনাভাইরাসের বর্তমান বিশ্বজোড়া মহামারীকে বুঝতে মেটাবলিক রিফটের ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ। আর এই দৃষ্টিভঙ্গীই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিষয়ে আমূল পরিবর্তনকামী সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গী। এই দৃষ্টিভঙ্গীই সামাজিক, এবং বিশেষ করে, পুঁজিবাদি সম্পর্ক বিশ্লেষণে প্রযোজ্য। বিগ ফার্মস মেক বিগ ফ্লু বইয়ের লেখক বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী রব ওয়ালেস ও তার বিজ্ঞানী সহকর্মীরা ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, কোভিড-১৯য়ের উৎপত্তি ও বিস্তার পুঁজির বিস্তারের সাথে সম্পর্কিত। মান্থলি রিভিয়ু-র মে মাসের সংখ্যায় তারা এ নিয়ে “কোভিড-নাইনটিন এণ্ড সার্কিটস অফ ক্যাপিটাল” শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, যেটির গুরুত্ব বিবেচনা করে মান্থলি রিভিউ অনলাইন ২৭ মার্চ প্রবন্ধটি আগাম প্রকাশ করে। বিগ ফার্মস মেক বিগ ফ্লু বইটি মান্থলি রিভিয়ু প্রেস ২০১৬ সালে প্রকাশ করে। উল্লেখ্য, রব ওয়ালেস একজন মহামারী বিশেষজ্ঞ এবং ভূগোলের যে শাখা মানুষের সমকালীন ভৌগলিক বিন্যাসের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ (ফাইলোজিওগ্রাফার)। পুঁজিবাদই ব্যাধির প্রধান উৎস বা সংক্রামক। ওয়ালেস ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন, সার্স-কোভ-২ এবং সাম্প্রতিক অন্যান্য নভেল ভাইরাসের উৎপত্তির কারণ প্রকৃতিতে কৃষি বাণিজ্যের তীব্র আগ্রাসন; যে আগ্রাসনের ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থাগুলো, প্রজাতিগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক ভেঙে গেছে এবং তৈরি হয়েছে বিশ্বজোড়া মহামারী উদ্ভুত হওয়ার মত পরিস্থিতি। “নোটস অন নভেল করোনাভাইরাস” (এম আর অনলাইন, জানুয়ারি ২৯, ২০২০) শীর্ষক এক প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন যে, এসবের কাঠামোগত সমাধান হচ্ছে, “এক ইকোসোশালিজম বা পরিবেশবাদী সমাজতন্ত্র যেটি প্রাণ-প্রতিবেশ-সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের ভাঙন এবং শহর, গ্রাম ও প্রকৃতির মধ্যকার ভাঙন মেরামত করবে, যাতে এসব ব্যাধির কোনোভাবেই আর উদ্ভব না হয়”।

পরিবেশবাদী ও ব্যাধিগত দিক থেকে ঘটনার সমালোচনার পদ্ধতি নতুন কিছু নয়। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত “ইংলণ্ডের শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা” গ্রন্থে শিল্প বিপ্লবের সময়কার রোগ-ব্যাধির পরিস্থিতি এবং বিশেষ করে সেটির শ্রেণিগত দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই পরিস্থিতির ফলে “গোটা সমাজ জুড়ে যে হত্যা” সংঘটিত হত, সেটির দিকে এঙ্গেলস দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মার্কসের পুঁজি বইতেও এ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এক শতাব্দীরও বেশি আগে চার্লস ডারউইন ও থমাস হাক্সলির শিষ্য এবং মার্কসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রাণীবিদ রে ল্যাঙ্কেস্টার তার কিংডম অফ ম্যান (১৯১১) গ্রন্থের “নেচারস রিভেঞ্জ” বা “প্রকৃতির প্রতিশোধ” অধ্যায়ে সাবধানবাণী দেন এই বলে যে, সব আধুনিক মহামারীর গোড়াতেই আছে প্রতিবেশের ক্ষেত্রে মানুষের দ্বারা সংঘটিত কৃত্রিম পরিবর্তন। তিনি লেখেন, “বিপুল পরিমাণে পশু ও শস্য উৎপাদনের লোভ থেকে মানুষ ক্ষেতে-খামারে অস্বাভাবিকভাবে জড়ো করেছে বিভিন্ন প্রজাতির দঙ্গল আর শহরে-নগরে তৈরি করেছে নিজের জাতের অস্বাভাবিক ভীড়। ফলে তৈরি হয়েছে পরজীবী, ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়া-প্রসূত নানা রোগ। পুঁজিবাদের কঠোর সমালোচক ল্যাঙ্কেস্টারের মতে এই সমস্যার দায় “বাজার” আর “লগ্নিপুঁজির বহুজাতিক বেনিয়া”দের। (এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য আমার নতুন বই দা রিটার্ন অফ নেচার : সোশালিজম এণ্ড ইকোলজি [মান্থলি রিভিয়ু প্রেস, ২০২০] দেখতে পারেন।) “প্রকৃতির প্রতিশোধ” নিয়ে ল্যাঙ্কেস্টারের সাবধানীবাণী প্রায় পুরোপুরিই উপেক্ষা করা হয়েছিল। তাই মান্থলি রিভিয়ু-র সেপ্টেম্বর ২০০০ সংখ্যায়, “ইজ ক্যাপিটালিজম এ ডিজিজ? (পুঁজিবাদ কি একটি ব্যাধি?)” প্রবন্ধে রিচার্ড লেভিন্স যুক্তি উত্থাপন করেন যে, মহামারীর ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণ “প্রচলিত জনস্বাস্থ্যবিদ্যা পৃথিবীর ইতিহাস, অন্যান্য প্রজাতি, বিবর্তন এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ—এই দিকগুলোর দিকে খেয়ালই দেয় নি”। এ ক্ষেত্রে ওয়ালেসের বিগ ফার্মস মেক বিগ ফ্লু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখেছে। এ বইতে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে যদি নতুন নতুন মহামারীর উদ্ভব থামাতে হয়, তাহলে সাম্রাজ্যবাদী কৃষিবাণিজ্যের পুরো কাঠামোটিই সম্পূর্ণ উৎখাত করা দরকার।

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই যে, মনুষ্য আধিপত্যের এই যুগে পুঁজিবাদ প্রজাতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং বায়ুমণ্ডলে নানা ভাঙন তৈরি করছে। আর, এর ফলে উদ্ভব হয়েছে আমাদের সমাজ-পরিবেশের সংকট। আর, এ সবেরই মূলে আছে সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বগুলো। পুঁজির একই ব্যবস্থা শ্রেণীগত ও সাম্রাজ্যবাদী বৈষম্য তৈরি করে, যেটির মাধ্যমে সে নিশ্চিত করে যে, সব চেয়ে গরীব ও দুর্বলরা সব চেয়ে বেশি পরিবেশগত ঝুঁকিতে থাকবে আর ধনীরা থাকবে আপেক্ষিকভাবে নিরাপদ: এ যেন এঙ্গেলস কথিত “সামাজিক হত্যা”র নতুন রূপায়ন।

ফারুক চৌধুরী: পৃথিবীর পরিবেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আপনার দা ভালনারেবল প্ল্যানেট [বিপন্ন পৃথিবী নামে বইটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে] বইতে বর্ণনা দেয়া হয়েছে কীভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতি আমাদের গ্রহের পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করেছে এবং আমাদের গ্রহের সমস্ত প্রাণকে হুমকির মুখে ফেলছে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিজ্ঞানকে মুনাফার বেদীতে বলি দিয়েছে। এই ব্যবস্থা চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রকৃতি বিজ্ঞানকে স্রেফ পুঁজি আহরণের হাতিয়ার করেছে। মানুষের আবাসস্থল তৈরি করা হয়েছে অযৌক্তিকভাবে, অমানবিকভাবে। এই বিশ্বজোড়া মহামারীর ফলে যে বাস্তবতা -- এত দেশের এত মানুষের মৃত্যু — সেটিকে কীভাবে দেখেন?      

জন বেলামি ফস্টার: পঁচিশ বছরেরও বেশি আগে যখন আমি দা ভালনারেবল প্ল্যানেট (মান্থলি রিভিয়ু প্রেস, ১৯৯৪) লিখি, তখন বইটি লেখার পেছনে কারণ ছিলো জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি, বন ধ্বংস এবং ওজোন স্তর ধ্বংস হয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ। এটি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, এই গ্রহের পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটের ভয়াবহতা ঠিকমত বুঝতে হলে এর পেছনের পুঁজিবাদী রাজনৈতিক-অর্থনীতি বুঝতে হবে। এক্ষেত্রে আমার প্রধান যুক্তি ছিলো যে, “বিশ্ব অর্থনীতির বিস্তারের সাথে সাথে মানুষের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো এই গ্রহের পরিবেশ-প্রতিবেশ চক্রকে দমানো শুরু করে, ফলে গ্রহজোড়া পরিবেশ-প্রতিবেশের এক অভূতপূর্ব সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়”। উপরন্তু, আবর্জনা ও বিষে ভর্তি কৃত্রিম রাসায়নিক সামগ্রী উৎপাদন এ অবস্থার আরো অবনতি ঘটায়। এসবের পেছনে কাজ করেছে একচেটিয়া পুজিঁবাদের কাঠামো, যেটি সম্পদ আহরণের সংকীর্ণ, অনড় যুক্তি ছাড়া আর কিছুই বুঝতে নারাজ। পুঁজিবাদ ও পরিবেশের সংঘাত একবিংশ শতাব্দীতে তৈরি করেছে একের পর এক দুর্যোগ; আর এরকমই চলতে থাকবে, যদি না মানবজাতি তার গতিপথ পরিবর্তন করে।

সেই সময়, এই পুরো যুক্তিটি আমার কাছে বেশ স্পষ্ট ছিলো। এই যুক্তি নিয়ে ক্রমাগত বৈজ্ঞানিক ঐকমত্যও গড়ে উঠছিল। বইটি বামপন্থীদের মধ্যে প্রতিবেশ বিষয়ে সচেতন মহলে প্রশংসিত হলেও, আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম এই দেখে যে, বাম ধারার সমাজতন্ত্রীদের বিভিন্ন অংশে বইটির তত্ত্ব কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে। যেমন, মার্কসবাদী ভূতাত্ত্বিক ডেভিড হার্ভে তার জাস্টিস, নেচার, এণ্ড দা জিওগ্রাফি অফ ডিসট্যান্স (ব্ল্যাকওয়েল, ১৯৯৬, ১৯৪-৯৬) বইতে আমার বইয়ের সমালোচনায় দাবী করেন যে, “পরিবেশ-প্রতিবেশের সম্পূর্ন ধ্বংস আসন্ন, এমন কেয়ামতের ঘোষণার মত আরো যত ঘটনা ইতিহাসে পাওয়া যায় সেগুলো খুবই সন্দেহজনক”। আমার বইতে বিশ্ব পরিবেশ বিপর্যয়ের বিপদকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হয়েছে দাবী করে হার্ভে আরো বলেন, “আমাদের পরিবেশের ভৌত পরিবর্তন ঘটিয়ে আমাদের প্রজাতির জীবন কোনোভাবে কম আরামদায়ক করে ফেলাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় অন্যায়”। এ নিয়েমান্থলি রিভিয়ুর এপ্রিল ১৯৯৮ সংখ্যায় হার্ভে ও আমার মধ্যে একটি বিতর্ক হয়।

এতগুলো বছর পরে এসে দা ভালনারেবল প্ল্যানেট নিয়ে আমার যে মূল আত্মসমালোচনা, সেটিও হার্ভের বক্তব্যের বিপরীত। তা হচ্ছে, পুঁজিবাদের পথে চলার ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের বিপদ বইটিতে অতিরঞ্জিত তো করা হয়ই নি, বরং, এই গ্রহের আসন্ন পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটের পুরো গুরুত্বটি ধরতে বইটি ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণ কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা, যেটি নিয়ে এখন আলোচনা করব না। এর আরো বছর পাঁচেক পরেই কেবল আমেরিকান জার্নাল অফ সোশিওলজির সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সংখ্যায় আমার “মার্কসস থিওরি অফ মেটাবলিক রিফট” প্রবন্ধটিতে আমি মার্কসের পরিবেশ বিশ্লেষণের পুনঃআবিষ্কার ও পরিবর্ধনের ওপর ভিত্তি করে একটি আরো বিকশিত ঐতিহাসিক-বস্তুবাদী সমালোচনা দাঁড় করাতে সমর্থ হই, যেটি পুঁজিবাদ ও আমাদের গ্রহের মধ্যকার সংঘর্ষকে আরো পূর্ণাঙ্গভাবে বুঝতে সহায়তা করে।

প্রাণ-প্রতিবেশ-সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের ভাঙ্গন বিশ্লেষণের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে পুঁজিবাদ এবং পরিবেশের নেতিবাচক দ্বন্দ্ব আরো ভালমতো বুঝতে পারা যায়। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রজাতি বিলুপ্তি, বন নিধন, বাণিজ্যিক খামারে পশু নির্যাতন, জীবাশ্ম জ্বালানি পুঁজি—এগুলোর বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতাসহ ই, পি, থম্পসনের বিধ্বংসীবাদ (এক্সটার্মিনিজম) এবং এমন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট অনুসন্ধান শুরু হয়। এই গবেষণাগুলো করেছেন ইয়ান এঙ্গাস, পল বার্কেট, ব্রেট ক্লার্ক, রেবেকা ক্লাউসেন, রায়ান গাণ্ডারসেন, হানাহ হলম্যান, স্টেফানো লংগো, ফ্রেড ম্যাগডফ, আন্দ্রেস মাল্ম, কোহেই সাইতো, এয়ামন স্লেটার, ডেল ওয়েস্টন ও রিচার্ড ইয়র্ক এবং পরিবেশ বিষয়ে গুরুত্ব প্রদানকারী আরো মার্কসবাদীরা (এ বিষয়ে বিস্তৃত গ্রন্থপঞ্জীর জন্য দেখুন রায়ান উইশার্ট, প্রমুখ, “দা মেটাবলিক রিফট: এ সিলেক্ট বিবলিওগ্রাফি”, মান্থলি রিভিয়ু অনলাইন)।   

তবে যাই হোক, পুঁজিবাদ-পরিবেশ-প্রতিবেশের দ্বন্দ্বের তত্ত্বকে স্রেফ পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের তত্ত্বের বিকল্প গণ্য করা বিরাট ভুল হবে। বরং এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই গ্রহের পরিবেশ বিপর্যয় এবং বিশ্বজোড়া পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়ত ব্যর্থতা — এগুলো পুঁজির যে কাঠামোগত সংকট আমাদের যুগের ইতিহাস নির্মাণ করছে, সেই সংকটের পারস্পরিক দ্বান্দ্বিক সম্পর্কযুক্ত উপাদান।  

ফারুক চৌধুরী: বিশ্ব মানবতা কখনো আজকের মত এমন পরিস্থিতিতে পড়ে নি। এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার পথ কী?

জন বেলামি ফস্টার: এর একমাত্র উত্তর হচ্ছে, যেমনটা বার্টোল্ট ব্রেখট (টেলস ফ্রম দা ক্যালেণ্ডার, মিথুয়েন, ১৯৬১) ঘোষণা দিয়েছিলেন অনেক আগে, যে বাড়িতে আগুন লেগেছে, সেখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। বামদের মধ্যে এ কথা আজকাল বেশ প্রচলিত যে, পুঁজিবাদের সমাপ্তির চেয়ে পৃথিবীর ধ্বংস কল্পনা করা সহজ। জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯ এবং বিশ্বজোড়া পুঁজিবাদের ঘনীভূত আর্থিক সংকটের মুখে এমন কথাবার্তা এখন উলটে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই পৃথিবী ধ্বংসের চেয়ে পুঁজিবাদের সমাপ্তি চিন্তা করা সহজ হয়ে উঠছে, এবং নিশ্চয়ই প্রথমটির আগে দ্বিতীয়টি ঘটবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনতা একটি প্রয়োজনীয়তা, এই সূত্র ধরে মানবতাকে আরো টেকসই, সমানাধিকারপূর্ণ বিশ্ব সৃষ্টির সংগ্রাম শুরু করতে হবে। এই বিশ্ব নির্মাণ করতে হবে যৌথভাবে, হাতের কাছের সমস্ত নতুন ও সৃজনশীল উপাদান দিয়ে। তবে নিজে-নিজেই এই পরিবর্তন ঘটবে না। এর জন্য দরকার সামির আমিন, দা ইমপ্লোশন অফ কনটেমপোরারি ক্যাপিটালিজম (মান্থলি রিভিয়ু প্রেস, ২০১৩, ১৪৬) বইতে যেমন বলেছেন, “ঔদ্ধত্য, আরো ঔদ্ধত্য, সবসময় ঔদ্ধত্য”। এর জন্য পুঁজিবাদের সাথে বৈপ্লবিকভাবে বিচ্ছেদ দরকার, তবে তা সংকীর্ণ অর্থে নয়, এবং এটাই সব নয়। তবে, সাম্রাজ্যবাদের সম্পূর্ণ কাঠামো, যে কাঠামোর মধ্যে দিয়ে বর্তমানে পুঁজি ও সম্পদ আহরিত হয়, তা থেকেও মুক্তি দরকার। সমাজের পুরো মৌলিক ভিত্তিটিকেই পাল্টে ফেলতে হবে। আমাদের বেছে নিতে হবে যে কোনো একটিকে—ধ্বংস বা বিপ্লব।                     

আজকের দিনের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে আলোকপাত করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
           
জন বেলামি ফস্টার ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সমাজতন্ত্রী সাময়িকী মান্থলি রিভিয়ুর সম্পাদক। পুঁজিবাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিবেশগত দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত তত্ত্ব ও ইতিহাস নিয়ে তিনি গবেষণা করে থাকেন। পুঁজিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনৈতিক সংকট, প্রতিবেশ ও প্রতিবেশের সংকট এবং মার্কসবাদী তত্ত্বের ওপর তার অসংখ্য প্রবন্ধ ও বই প্রকাশিত হয়েছে: (পল বার্কেটের সাথে যৌথভাবে) মার্কস এণ্ড দা আর্থ: এন এন্টি-ক্রিটিক (২০১৬); দা থিওরি অফ মনোপলি ক্যাপিটালিজম: এন ইলাবোরেশন অফ মার্কসিয়ান পলিটিকাল ইকোনমি (নতুন সংস্করণ, ২০১৪); (রবার্ট ডব্লিউ ম্যাকচিসনির সাথে যৌথভাবে) দা এণ্ডলেস ক্রাইসিস: হাও মনোপলি ফাইনান্স ক্যাপিটাল প্রোডিউসেস স্ট্যাগনেশন এণ্ড আপহিভাল ফ্রম দা ইউএসএ টু চায়না (২০১২); (ফ্রেড ম্যাগডফের সাথে যৌথভাবে) হোয়াট এভ্রি এনভায়রনমেনটালিস্ট নিডস টু নো এবাউট ক্যাপিটালিজম: এ সিটিজেনস গাইড টু ক্যাপিটালিজম এণ্ড দা এনভায়রনমেন্ট (২০১১); (ব্রেট ক্লার্ক এবং রিচার্ড ইয়র্কের সাথে যৌথভাবে) দা ইকোলজিকাল রিফট: ক্যাপিটালিজম’স ওয়ার অন আর্থ (২০০৯); (ফ্রেড ম্যাগডফের সাথে যৌথভাবে) দা গ্রেট ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস: কজেস এণ্ড কনসিকুয়েন্সেস (২০০৯); দা ইকোলজিকাল রেভ্যুলিউশন: মেকিং পিস উইথ দা প্ল্যানেট (২০০৯); (ব্রেট ক্লার্ক ও রিচার্ড ইয়র্কের সাথে যৌথভাবে) ক্রিটিক অফ ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন: ম্যাটেরিয়ালিজম ভার্সেস ক্রিয়েশনিজম ফ্রম এন্টিকুইটি টু দা প্রেসেন্ট (২০০৮); ইকোলজি এগেইন্সট ক্যাপিটালিজম (২০০২); মার্কসেস ইকোলজি: ম্যাটেরিয়ালিজম এণ্ড নেচার (২০০০); (ফ্রেডরিখ এইচ. বাটেল ও ফ্রেড ম্যাগডফের সাথে যৌথভাবে) হাংরি ফর প্রফিট: দা এগ্রিবিজনেস থ্রেট টু ফার্মার্স, ফুড এণ্ড দা এনভায়রনমেন্ট (২০০০); দা ভালনারেবল প্ল্যানেট: এ শর্ট ইকোনমিক হিস্টোরি অফ দা এনভায়রনমেন্ট (১৯৯৯); (এলেন মেইসকিন্স উড ও রবার্ট ডব্লিউ. ম্যাকচিসনির সাথে যৌথভাবে) ক্যাপিটালিজম এণ্ড দা ইনফরমেশন এজ: দা পলিটিকাল ইকোনমি অফ দা গ্লোবাল কমিউনিকেশন রেভ্যুলশন (১৯৯৮); (এলেন মেইসকিন্স উডের সাথে যৌথভাবে) ইন ডিফেন্স অফ হিস্টোরি: মার্কসিজম এণ্ড দা পোস্টমডার্ন এজেণ্ডা (১৯৯৭); দা থিওরি অফ মনোপলি ক্যাপিটালিজম: এন ইলাবোরেশন অফ মার্কসিয়ান পলিটিকাল ইকনমি (১৯৮৬); (হেনরিক শ্লাইফারের সাথে যৌথভাবে) দা ফল্টারিং ইকোনমি: দা প্রবলেম অফ একুমুলেশন আণ্ডার মনোপলি ক্যাপিটালিজম (১৯৮৪)। অন্তত পঁচিশটি ভাষায় তার বই ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ফস্টারের বেশিরভাগ গ্রন্থ ও প্রবন্ধ পাবেন এখানে:
johnbellamyfoster.org  

ফারুক চৌধুরী লেখালেখি করেন। তার ইংরেজি বইয়ের মধ্যে আছে মাইক্রো ক্রেডিট, মিথ ম্যানুফ্যাকচারড (সম্পা.), দা এজ অফ ক্রাইসিস এবং দা গ্রেট ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিস, হোয়াট নেক্সট? ইন্টারভিউজ উইথ জন বেলামি ফস্টার (সম্পা., ২০১২)।

অনুবাদক: ওমর রাদ চৌধুরী, শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।

Apr 25, 2020


Omar Raad Chowdhury omar.raad.chowdhury@gmail.com

Your Comment if any